পরমাণুনিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিম: ট্রাম্প
আসিফুজ্জামান পৃথিল, লিহান লিমা: উত্তর কোরিয় নেতার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের বৈঠকের পর ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন দুই রাষ্ট্রপ্রধান। তবে ৫ ঘণ্টার এই বৈঠকে দুই নেতার আন্তরিক করমর্দন, একান্তে আলোচনা, একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ ও পারস্পরিক হৃদতার আনুষ্ঠানিকতার উচ্ছ্বাসে কিছুটা চাপা পড়ে গেছে পরমাণুনিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার দৃঢ় নিশ্চয়তা। আল জাজিরা জানায়, যৌথ বিবৃতিতে দুই নেতাই সর্ম্পূণ পরমাণুনিরস্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন। বিবিসিও এটিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে সম্মোধন করে। তবে সিএএন জানায়, ‘কিমের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের জের ধরে শেষ হয়েছে ট্রাম্পের উত্তর কোরিয় বিদ্বেষ। পাঁচ ঘন্টার এই বৈঠক নতুন বন্ধুত্বের বার্তা দিলেও আলংকরিক থেকে গিয়েছে পরমাণুনিরস্ত্রীকরণ ইস্যু।’ রয়টার্স জানায়, প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শেষ হল দ্বি-পক্ষীয় সম্মেলন। আল জাজিরা বৈঠকের চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। প্রথমত, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের জনগণের শান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্য দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার কথা ঘোষণা করে। দ্বিতীয়ত, দুই দেশই কোরিয় উপদ্বীপে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কথা জানায়। তৃতীয়ত, উত্তর কোরিয়া পরমাণুনিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। চতুর্থত, কোরিয় যুদ্ধের সময়কালীন যুদ্ধবন্দী ও নিখোঁজ সৈনিকদের ফিরিয়ে দেয়ার ব্যপারে ঐকমত্য।
গতকাল সকালে সিঙ্গাপুরের সান্তোসা দ্বীপে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ট্রাম্প কোরিয় উপদ্বীপে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে চলমান সামরিক মহড়া বন্ধের ঘোষণা দেন। তবে কিমের কাছ থেকে এখনো কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় নি। কিমের সঙ্গে বৈঠক সম্পর্কে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা দুজনেই বিশেষ সম্পর্কের সূচনা করেছি। দুইজনেই একসঙ্গে কিছু করতে চাই। মানুষ চমকে গিয়েছে এবং খুশি হয়েছে। এই বৈঠক ছিল প্রত্যাশারও বেশি কিছু। এটি অনেক বড় সমস্যার সমাধান করবে। ’
অন্যদিকে ট্রাম্পের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কিম বলেন, ‘অনেক মানুষই এটিকে ফ্যান্টাসি কিংবা সায়েন্স ফিকশন মুভি মনে করবে।’ বৈঠকের আগেও কিম বলেছিলেন, আমরা অতীতকে পেছনেই রাখতে চাই। বিশ্ব একটি বড় পরিবর্তন দেখবে। বৈঠক শেষে একে অপরকে আন্তরিক বিদায় জানান দুই নেতা। ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের দেখা হবে আবার, আরও অনেকবার।’
ট্রাম্প এবং কিমের স্বাক্ষরিত নথিতে বলা হয়, উত্তর কোরিয় নেতা কোরিয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণরুপে পরমাণুনিরস্ত্রীকরণের পক্ষে তার আন্তরিক এবং দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পও উত্তর কোরিয়াকে ‘পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা’ দেয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বের কথা মোতাবেক ‘পূর্ণাঙ্গ, পরীক্ষীত এবং স্থায়ীভাবে’ পরমাণুনিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। কিমও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইনকে দেয়া এপ্রিলের প্রতিশ্রুতি একবারের জন্যও ব্যক্ত করেন নি। বিশ্লেষকরাও বলছেন, অতীতের ভুল এড়াতে কোন কিছুই করা হয় নি। তবে অনেকে মনে করছেন, এটি ঐতিহাসিক সূচনার প্রথম পদক্ষেপ। আরো অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে।
শীর্ষ বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের করা প্রশ্নেরও জবাব দেন। সম্মেলনের শুরুতে বিশ্ববাসিকে অভিনন্দন জানান ট্রাম্প। এছাড়াও তিনি সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিক এবং আয়োজক সিঙ্গাপুরকেও সফল আয়োজনের জন্য অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানান। তিনি একই সাথে দক্ষিুণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবেকেও ধন্যবাদ দেন। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং একং দক্ষ নেতা ও বন্ধুর মতো আচরণ করেছেন বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের বৈঠক সৎ, পরিচ্ছন্ন এবং খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। ৭০ বছর আগে বিশাল এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো। যা আজকেই সমাধান হবে না। তবে অচিরেই আমরা এর একটি সমাধান দেখতে পাব। কিম আমি একটি যৌথচুক্তি সই করেছি যেখানে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিম আমাকে বলেছে, সে ইতোমধ্যেই তার কয়েকটি পরীক্ষাগার ধ্বংস করেছে। বাকিগুলোও ধ্বংসের অঙ্গীকার করেছে সে। যুদ্ধ তো যে কেউ বাঁধাতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র সাহসীরাই যুদ্ধ থামাতে পারে। অবরোধ থাকবে। আমরা চাই কোরীয় জনগণ একদিন দারিদ্রমুক্ত হবে। আজকের দিনটি বিশ্বশান্তির ইতিহাসের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন।’
কিম জং উনকে চেয়ারম্যান কিম সম্মোধন করে তার প্রশংসা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘কিম ছাড়া এটা সম্ভব হত না। সে অনেক বড় সুযোগ পেয়েছে আগে কেউ পায়নি। দুইদেশের জন্য নতুন ইতিহাস লেখা শুরু হবে।’
তবে ট্রাম্প এও জানিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিত ঘাঁটি থেকে এখনই সেনা প্রত্যাহার করবে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে ধীরে ধীরে কোরিয় উপদ্বীপে সামরিক মহরা বন্ধ করে দেবে মার্কিনিরা। ট্রাম্প মনে করেন এ ধরণের কাজে অর্থব্যয় বাতুলতা। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া থেকে এখনই সেনা প্রত্যাহার নয়। আমরা অর্থের অপচয় রোধে সামরিক মহড়া বন্ধ করা হবে। তবে তা রাতারাতি সম্ভবপর নয়। সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করতে সম্মত হয়েছে কিম। এটি অবশ্যই নিশ্চিত করবে যুক্তরাষ্ট্র। কিম আমাকে বলেছে, আমরা আর আগের অবস্থায় ফিরে যাব না। আমরা খুবই বিস্তারিত ও পরিচ্ছন্ন চুক্তি সই করেছি।’
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি পিয়ংইয়ং যাবেন। কিমকেও কখনও হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানাবার ইচ্ছা আছে তার। তিনি বলেন, ‘কবে পিয়ংইয়ং যাবো? যথার্থ সময়েই যাব। আর আমি কিমকেও হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।’
ট্রাম্প আরো জানান, সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের আগে পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার উপর দেয়া অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে না। তবে নতুন করে আর কোন অবরোধ আরোপ করা হবেনা বলেও জানান ট্রাম্প। তিনি আরো জানিয়েছেন আলোচনা ফলপ্রসু না হলে সমাজতান্ত্রিক দেশটির উপর নতুন করে আরো ৩০০ অবরোধ দিতে প্রস্তুত ছিলো তার দেশ। আল জাজিরা, সিএনএন।