ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘গ্রেট গেমের’ মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশ
মাছুম বিল্লাহ: ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশকে নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। ভারত ও চীনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই বাড়ছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘গ্রেট গেমের’ মধ্যে বাংলাদেশ ততই জড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এশিয়ার দুই উদীয়মান শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটা এখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই এখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। বাংলাদেশ ও ভারতীয় কয়েকজন কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বরাতে ইউরোয়েশিয়া রিভিউয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশ এ অঞ্চলের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নিম্ন উন্নত দেশ। তবে ২০২৪ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত হবে বলে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।
আগামী দশকে বাহ্যিক অবকাঠামোগত এবং মানব সম্পদের উন্নয়নের বিষয়টি বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকবে। বাংলাদেশ তাই চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগটাকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে চায়। ভারতের কূটনৈতিক উঠোন খ্যাত দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পদচারণা খুব বেশি পুরনো নয়। পাকিস্তানের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের বিষয়টি বাদ দিলে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিগত দুই দশকে। এই অল্প সময়েই চীন এ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
২০০৫ সালে বাংলাদেশে রফতানিকারক দেশ হিসেবে ভারতকে টপকে যায় চীন। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বাণিজ্যের মাধ্যমে এটা ঘটেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মধ্যে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। চীনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হলো পাকিস্তান।
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরের সময় অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ২৪.৪৫ বিলিয়ন ডলারের বিপুল অঙ্ক বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। আগের ১৩.৬ বিলিয়ন ডলারসহ এতে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের অঙ্কের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। কোন একক দেশ কর্তৃক বাংলাদেশকে দেয়া এটাই সর্বোচ্চ সহায়তা।
কিন্তু বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) মেগা প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশে যে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে, এর মধ্যে বর্তমানে শুধু ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারের পায়রা কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দের কাজ চলছে। ঢাকা-যশোর রেলরোড স্থাপনের বিষয়টি এখনও পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে আর কর্ণফুলী নদীতে পানির নিচ দিয়ে টানেল নির্মাণের কাজটি মাত্র শুরু হয়েছে।
অর্থ ছাড়ের গতি ধীর হলেও এই প্রকল্পগুলো যথেষ্ঠ আকর্ষণীয়। এ কারণেই চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচিকে সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশ। অতি সম্প্রতি ভারতকে টেন্ডারে হারিয়ে দিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছে চীন।
এই সবগুলোই ভারতের জন্য খারাপ খবর। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিআরআইয়ের বিরোধিতা করেছে। জল ও স্থল উভয় দিক থেকে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলছে। সাগরে বেশ কিছু বন্দর মিলিয়ে স্ট্রিং অব পার্লস গড়ে তুলছে চীন। ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই বাড়ছে। বাংলাদেশ ততই দুই দেশের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠছে। চীনকে মোকাবেলার জন্য মোদি সরকারের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ এবং ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিগুলোর মধ্যে এ বিষয়টিই ফুটে উঠেছে।
এ অঞ্চলে ভারতের অবস্থান দুর্বল হওয়ার কারণে সেটা বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে সব সময় বাড়তি সুবিধা দিয়ে আসছে বলে যে সমালোচনা রয়েছে দেশের মধ্যে, সেটাকে সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন হাসিনা। কারণ বাংলাদেশের সমাজের মধ্যে এই ধারণাটি গভীরভাবে প্রোথিত।
বাংলাদেশ এ বিষয়ে খুবই সচেতন যে ভারত ও চীন উভয়েই বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবে। ভারত-চীন প্রতিযোগিতার মধ্যে সর্বোচ্চ অর্জনের জন্য দুই দেশের মধ্যে কোন একটি সুস্পষ্টভাবে বেছে নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশকে সতর্ক কৌশল গ্রহণ করতে হবে।