৬৯ বছরের মধ্যে ৪৯ বছরই বিরোধী দলে
নিজস্ব প্রতিবেদক: ৬৯ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ মাত্র ২০ বছরের সামান্য বেশি সময় ক্ষমতায় আসীন ছিল, বাদ বাকি ৪৯ বছরই দলটি ছিল ক্ষমতার বাইরে বা বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে। যে কারণে অনেক বিশ্লেষকই আওয়ামী লীগকে বলে থাকেন “স্থায়ী বিরোধী দল”। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরোনো ঢাকার টীকাটুলীস্থ রোজ গার্ডেনে উপমহাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বাইরে গিয়ে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। মাত্র ৬ বছরের মাথায় দলটি নিজেদের নাম পরিবর্তন করে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নাম গ্রহণ করে। আর তৎকালীন পাকিস্তানে দলটি নিজেদের পরিচয় দেয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ হিসেবে। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী। ২৪শে জুন আরমানী টোলা মাঠে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন কমিটিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। পরের বছরই তিনি পান পূর্ণ সাধারণ সম্পাদকের পদ। দীর্ঘ ১৩ বছর তিনি এই দলটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ে দলটির বাংলা ভাষার দাবি আদায়সহ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, এক ব্যক্তির এক ভোট, সংবিধান প্রণয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যেকার বৈষম্য দূরীকরণে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
১৯৫৪ সালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে দলটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসনে চলে আসে এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে। প্রদেশের ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করে এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই লাভ করে ১৪৩টি আসন। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকারের মেয়াদ বছর পূর্তির আগেই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে শেষ করে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে আওয়ামী লীগ মাত্র ৩ বছর ১ মাস ক্ষমতাসীন ছিল, তার মধ্যে ১৩ মাসই ছিল সোহ্রওয়ার্দীর নেতৃত্বে একটি কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হিসেবে। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠা করলে, তার সঙ্গে যারা আওয়ামী লীগ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে অনেকেই বেরিয়ে যান দলটি থেকে। অনেকেই তখন দলটিকে দুর্বল হয়ে রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে যাবে বলে মনে করেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজ উদ্দিন আহমদসহ জাতীয় চার নেতার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তি সনদ ৬-দফা নিয়ে দলটি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ায় এবং বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে অতি অল্প সময়ের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে দাঁড় করাতে সক্ষম হলেও মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একই সঙ্গে কারাভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর সহকারী জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের পথ উন্মুক্ত হয় এবং দীর্ঘ প্রায় দুই দশক বাংলাদেশে সামরিক শাসন বলবত থাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশে স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং দলটির নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। দীর্ঘ ২১ বছর রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর দেশ পরিচালনার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর শেষে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে নামে। বাংলাদেশে এর আগে বা পরে কখনোই এরকম শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসন গ্রহণ করে। ২০০৮ সালে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং পরবর্তী মেয়াদেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।