যুক্তরাষ্ট্রের ইউএনএইচআরসি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ও শ্রীলঙ্কার যুদ্ধকালীন অভিযোগ
সাউথ এশিয়ান মনেটর: শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত অতুল কেশপ গত ১৯ জুন সৌজন্য সাক্ষাৎকালে সাবেক প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপাকসাকে কী বার্তা দিয়েছেন তা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে স্থানীয় মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা চলছে।
খবরে প্রকাশ, তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টকে এই বলে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তার ছোট ভাই সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপাকসা যদি ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মহিন্দা রাজাপাকসার নেতৃত্বাধীন শ্রীলঙ্কা পদু জনা পেরামুনা (এসএলপিপি)-জয়েন্ট অপজিশনের প্রার্থী হয়, তবে জয় পাওয়া যাবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, প্রার্থীর ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাদের সামনে বেশ কয়েকজন প্রার্থী আছেন। যথাযথ সময়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি গোটাবায়া রাজাপাকসার প্রেসিডেন্ট হওয়ার চেষ্টা সত্যিই ভ-ুল করে দিতে চায়, তবে তারা তার মার্কিন নাগরিকত্ব ত্যাগের অনুমতি দিতে বিলম্ব করবে। এর ফলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারবেন না।
শ্রীলঙ্কার নিয়ম অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে শ্রীলঙ্কার নাগরিক হতে হবে। তিনি অন্য কোনো দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবেন আর কে পারবেন না, সে ব্যাপারে নাক গলানোর ঘটনায় গোটাবায়ার শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষই প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
তার সমর্থন ও বিরোধিতা প্রায় সমান সমান। তবে ওইসব বিতর্ক ছাপিয়ে এখন যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে আলোচনা হচ্ছে তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের চলতি সপ্তাহের ইউএনএইচআরসি ত্যাগের ফলে শ্রীলঙ্কার যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা নিয়ে তথা শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীর জবাবদিহিতার ওপর এর কোন প্রভাব পড়বে কিনা। এ নিয়ে দুটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। একটি হলো ইউএনএইচআরসি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়াটা কোনো প্রভাব সৃষ্টি করবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র এখনো পাশ্চাত্য ব্লকের সাহায্যে এবং সেইসাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকায় তার মিত্রদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন জেনেভায় জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. দায়ান জয়াতিলেকে, অর্থনীতিবিদ অহিলান কাদিরগামার ও মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট শেরিন জ্যাভিয়ার।
অন্যরা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার ফলে গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনীর জবাবদিহিতার বিষয়টি নিয়ে নতুন মাত্রার সৃষ্টি হবে। এখন শ্রীলঙ্কা বিষয়টি যথাযথভাবে সামাল দিতে পারলে আন্তর্জাতিক বিচারকদের নিয়োগের মাধ্যমে বিচার করার ব্যবস্থাটি বাতিল করা সম্ভব হবে।
এদিকে শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত শ্রীলঙ্কা সরকারকে বলেছেন, ২০১৫ সালের প্রস্তাবটি বাস্তবায়নে শ্রীলঙ্কাকে সহায়তা করা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।
অর্থাৎ গৃহযুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য শ্রীলঙ্কার সশস্ত্র বাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করছ না। আবার যুক্তরাষ্ট্র ইউএনএইচআরসি থেকে স্থায়ীভাবে সরে গেল কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়ে গেছে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বদলে ফেলেন। কাজটি তিনি বেশ ভালোভাবেই করতে পারেন।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে গঠনের সময় যুক্তরাষ্ট্র এই সংস্থা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। তবে ২০০৯ সালে এতে যোগ দেয়। এদিকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ও আরো কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশ তামিল স্বার্থের ব্যাপারে সোচ্চার। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অন্য প্রায় সব ইউরোপিয়ান দেশের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় তামিলরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
তামিল ইস্যুটির সমাধান করার জন্য শ্রীলঙ্কার কাছে সবচেয়ে বড় সুযোগ এসেছিল প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজপাকসার ২০০৯ সালে যুদ্ধ অবসানের পরপরই গঠিত ‘লেসনস লার্নট অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন (এলএলআরসি)’ গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু এলএলআরসির সুপারিশমালা কখনোই বাস্তবায়ন করা হয়নি। রাজাপাকসা বা সিরিসেনার কেউ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
শ্রীলঙ্কার সিংহলি প্রাধান্যের সরকারগুলো ভোটের জন্য সিংহলি-বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজনকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে থাকে। এর ফলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। তবে এখনো তামিলদের মধ্যে অনেক গ্রুপ আছে, যারা বিশ্বাস করে সাংবিধানিকভাবেই তাদের সমস্যার সমাধান সম্ভব, সিংহলি ও তামিলদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যেতে পারে। প্রধান তামিল দল তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স মনে করে, নতুন সংবিধান নতুন দিনের স্বপ্ন দেখাবে, তামিল ভাষাভাষী প্রদেশ নর্থ ও ইস্টকে আরো স্বায়াত্তশাসন দেওয়া হবে।
এই প্রেক্ষাপটেই গোটাবায়া ইস্যুটি সামনে এসেছে। তিনি তামিল ইস্যুতে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন। তিনি ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তামিলদের সাথে সিংহলিদের সঙ্ঘাত আরো বাড়তে পারে।