হেলমেট পরিহিত যুবকদের হামলা-সংঘর্ষ সাংবাদিকসহ আহত অর্ধশতাধিক ৮ম দিনেও শিক্ষার্থীরা রাস্তায়, পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস শেল নিক্ষেপ
সুশান্ত সাহা: নিরাপদ সড়কের দাবিতে ৮ম দিনেও শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বেশকিছু এলাকায় অবস্থান নেয়। তবে গতকাল সকাল থেকে সরব ছিল ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। ঝিগাতলা, ফার্মগেট, সাইন্স ল্যাবরেটরী, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীদের উপর হেলসেঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে।
ঝিগাতলায় সংঘর্ষ চলাকালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দফায় দফায় কাঁদুনে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। এসব ঘটনায় সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, পথচারীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১১ শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ তৎপর ছিল।
সায়েন্স ল্যাবরেটরী এলাকা থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার রিকু আমির ও শাহাদাত হোসেন জানান, সকাল ১০টা থেকে বেলা পৌনে তিনটা পর্যন্ত সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে বাটা সিগন্যাল মোড় পর্যন্ত পুলিশ ও সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপও করা হয়। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছোঁড়ে। সর্বশেষ বেলা পৌনে তিনটায় বাটা সিগন্যাল মোড়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এসময় প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে আন্দোলনকারীরা হাতিরপুল মুখী সড়ক ও কাঁটাবনমুখী সড়ক দিয়ে পিছু হটে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন। যাদের পপুলার, ল্যাবএইডসহ আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে। শিক্ষর্থীদের মিছিলে হেলমেট পরে হকিস্টিক, দেশীয় অস্ত্র হাতে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এতে আহত ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী রাহাত করিম বলেন, আমি শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। ছাত্রলীগ আমাদের দিকে ইট ছুড়ে মেরেছিল। আমি দৌঁড় দেয়ার পর একজন আমার পা ধরে ফেললে আমি পড়ে যাই। তারা আমার মাথায় ও পায়ে আঘাত করেছে। পুলিশ পাশেই দাঁড়িয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী মারুফ হোসেন বলেন, এক শিক্ষার্থীর মাথা রক্তে তার মুখ ভিজে যেতে দেখলাম। তারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছে। তারা কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিল।
এদিকে সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে তাদের ওপর চড়াও হয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের মারপিটে আহত হন বার্তা সংস্থা এপির ফটোসাংবাদিক এমএন আহাদ। তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, মাথায় হেলমেট পরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিলে হামলা করে। মুহূর্তেই মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে মিছিলকারীরা বিভিন্ন মার্কেটে ও ফুটওভার ব্রীজে উঠে গেলে সেখানেও হামলা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে রিপোর্টার রবিন আকরাম জানান, বেলা ১টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মিছিল বের করে। সেখানে বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। ওই সময় হাজার হাজার শিক্ষার্থী জিগাতলার দিকে মিছিল নিয়ে যায়। ওই সময় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের দিকে অবস্থান নেওয়া পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। কাঁদনে গ্যাস থেকে বাঁচতে অনেক শিক্ষার্থী লেকের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে ও ঢিল ছোড়ে। কয়েকজনকে পানি থেকে টেনে তোলে পুলিশ। ওই সময় তিন শিক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
ঝিগাতলা এলাকা থেকে আমাদের রিপোর্টার কায়েস চৌধুরী জানান, দুপুর ১টার দিকে ঝিগাতলায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। পরে হেলমেট পরা লাঠিসোটাসহ বেশ কিছু সংখ্যক যুবক শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। এসময় আহত হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
রাজধানীতে যানচলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। তবে গণপরিবহনের অভাবে সাধারণ মানুষ ব্যাপক দুর্ভোগে রয়েছে। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য যাত্রীদের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
ফার্মগেটে বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী কবির বলেন, আমি যাব উত্তরা কিন্ত কোনো বাস নেই। মাঝে মাঝে বিআরটিসি বাস আসলেও সেগুলাতে ওঠার মত কোনো জায়গা নাই। দুই ঘন্টা ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। অপর এক যাত্রী রেজা বলেন, সিএনজিতে এখান থেকে উত্তরার ভাড়া চেয়েছে ৪শ’ টাকা। এটা কি করে সম্ভব।
ছাত্র না হয়েও সাদা শার্টের কারণে হামলার শিকার: ছাত্র নয়, কিন্তু পরনে সাদা শার্ট ও কাঁধে ব্যাগ থাকার কারণে কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়েছেন। ঢাকা আইনজীবী সমিতি অফিসের স্টাফ রাজিব বলেন, বেলা ১২টার দিকে বিসিএসআইআর গেটের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছিলাম, পরণে ছিল সাদা শার্ট। হঠাৎ হেলমেট পরিহিত একদল যুবক লাঠিসোটা নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসে এবং হালকা আঘাত করে। পরে আমার আইডি কার্ড দেখে ছেড়ে দেয়। কিন্তু মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে।
সায়েন্স ল্যাব ব্রিজের নিচে একটি বেসরকারি অফিসের কর্মচারি লাঞ্ছিত ও মারধরের শিকার হন সাদা শার্টের কারণে। রফিক নামের এই কর্মচারি বলেন, সাদা শার্ট আমার অফিসের ড্রেস। কথা নাই, বার্তা নাই, ধর ধর বলে আমাকে মারা শুরু করে হেলমেট পরা যুবকরা। পরে বুঝেছে, আমার পরিচয় পেয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে আমাকে অনেক মেরেছে। একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মচারি তন্ময়ও ঢাকা কলেজের কাছে হেলমেট পরা যুবকদের হাতে মারধরের শিকার হন। তার পরনেও ছিল সাদা শার্ট।
উল্লেখ্য, ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে এমইএস বাস স্ট্যান্ডে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাসচাপায় নিহত হন মিম ও করিম নামে দুই শিক্ষার্থী। ওই দুর্ঘটনায় ১০-১৫ জন শিক্ষার্থী আহতও হন। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে আসছে।