কেমন আছেন গ্রামের মানুষ?
বিভুরঞ্জন সরকার
মাত্র দু’দিনের জন্য ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে। পঞ্চগড় জেলার বোদায়। না, আমি মানুষের অবস্থা দেখতে যাইনি। তবে নানা উপলক্ষে অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। নানা বয়সের, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, কেমন আছেন? প্রায় সবাই নির্দ্বিধায় জবাব দিয়েছেন, ভালো আছি। তবে ব্যতিক্রম আছে। যারা সরাসরি রাজনীতি করেন, কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যাদের যোগ-সংযোগ আছে; তারা এক কথায় জবাব দেন না। ‘কেমন আছেন’- এই সরল প্রশ্নের জবাব দিতেও তারা সময় নেন, মনে মনে রাজনীতির প্যাচ কষেন। যারা আওয়ামী লীগ বা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, তারা সরাসরি জবাব দেন। নিজের কথা না বলে সবার হয়ে বলেন, মানুষ খুব ভালো আছেন। বর্তমান সরকার এত উন্নয়ন করেছেন যে; মানুষ এখন আর অভাবে নেই, না খেয়ে নেই।
আবার যারা বিএনপি বা বিরোধী দলে আছেন; তারা বলেন, মানুষ ভালো নেই। বাক স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র নেই। বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের অধিকার নেই। যারা আওয়ামী লীগের, ভালো আছে তারা।
মানুষ খেয়েপরে বেঁচে আছে, না অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে সরকারবিরোধীরা বলেন, খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই কি মানুষের জীবনে সব? অধিকারহীন মানুষ ভালো থাকতে পারে না।
যারা কোনো দল করেন না, তারা কিন্তু বেশ স্পষ্ট করেই বলেন, ভালো আছি। শেখ হাসিনার শাসনে কোনো মানুষের খাওয়া-পরার কষ্ট নেই। তবে, কৃষক তার ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে এখনো বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার-নির্ধারিত দামে ক্ষুদ্রকৃষক ধানচাল বেচতে পারেন না। তবে উৎপাদন খরচের থেকে কম দাম পান না। কৃষি উপকরণ সহজলভ্য। সার পাওয়া যায়, সেচ সুবিধা পর্যাপ্ত। কৃষকের তাই কোনো হাহাকার নেই। তাছাড়া বড় কথা হলো, মানুষের সামনে এখন আয় বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। কৃষক শুধু কৃষিকাজ করছেন, তাই নয়। কেউ ছোটখাট ব্যবসা করছেন, কেউ রিকশাভ্যান বা বাইক চালাচ্ছেন। বাড়তি আয় করছেন। আগে অনেক কৃষকের কাছেই নগদ টাকা থাকতো না। এখন প্রায় সব মানুষের হাতেই কিছু না কিছু টাকা আছে।
গ্রামাঞ্চলে ভিক্ষুক প্রায় নেই বললেই চলে। কেউ কারো কাছে হাত পাততে চান না। কাজ করে উপার্জন করতে চান এবং উপার্জন করার কোনো না কোনো সুযোগ আছে। দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাও নিজেদের শিক্ষাব্যয় নির্বাহের জন্য প্রয়োজনে কায়িক শ্রমের কাজও করছেন। কয়েকজন কলেজ ছাত্র আংশিক সময় রাজমিস্ত্রির যোগালির কাজ করে দিনে দুই/তিনশ’ টাকা রোজগার করছেন।
আগে বাজারে কর্মহীন কিছু মানুষকে সারাদিন আড্ডা দিতে দেখা যেত। কেউ এক কাপ চা খাওয়ালে বর্তে যেত। সে রকম মানুষ এখন আর নেই। ব্যবহৃত পুরনো কাপড় নেওয়ার জন্য আগে অনেকেই বাড়ি বাড়ি ধরনা দিত। এখন পুরাতন কাপড় কেউ নিতে চায় না। অর্থনৈতিক সঙ্গতি বেড়েছে বলেই মানুষের আত্মমর্যাদাবোধও বেড়েছে।
হ্যাঁ, সমাজে বৈষম্য আছে। কারো কারো অবস্থা আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেটা ভিন্ন বিতর্ক বা আলোচনা। কিন্তু সাধারণভাবে মানুষ খালি পেটে এবং উদোম শরীরে নেই। মানুষ ব্যস্ত আছে, কাজে আছে। মানুষের এই পরিবর্তনগুলো যারা চোখে দেখেন না, যারা পুরাতনি ধারায় সরকারের সমালোচনা করেন, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে রাজনীতির বাজার গরম করতে চান; তাদের জন্য সময়টা ভালো নয়। রাজনীতিতে জায়গা করতে হলে এখন বলতে হবে, এখন মানুষ যেভাবে দিন কাটাচ্ছেন, তার থেকে কীভাবে আরো ভালো কাটাতে পারবেন; তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তুলে না ধরে ফাঁকা বুলি আউড়ে সুবিধা করা যাবে বলে মনে হয় না। সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব