স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ : প্রয়োজন কঠোর ও সর্তক বাস্তবায়ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : চোরাচালান ও স্বর্ণ খাতে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। নীতিমালার অভাবে এ খাতে বেশ অরাজকতা ছিল। এ ছাড়া নতুন নীতিমালায় পরিষ্কার করা হয়েছে অলঙ্কারের সংজ্ঞাও। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ও বিদেশে স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানি করার লক্ষ্যে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়া সহজিকরণ এবং স্বর্ণ আমাদানি ও পরবর্তী বাণিজ্যিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিধানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আমদারিকারক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা হবে এ নীতিমালায়। এ ছাড়াও স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানিতে উৎসাহ এবং নীতিগত সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ করাও এ নীতিমালার লক্ষ্য। স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্ক ও ঋণ সুবিধা যৌক্তিকীকরণ ও সহজীকরণে এ নীতিমালা ব্যবহৃত হবে ।
স্বর্ণ খাতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় ও নিরীক্ষাগত যাবতীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে। ভোক্তা বা ক্রেতা স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ এ খাত সংশ্লিষ্ট অংশীজনের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সকল অংশীজনের অংশীদারিত্ব ও কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে স্বর্ণখাতের সুষ্ঠু ও টেকসই বিকাশের জন্যে একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করাও হবে এ নীতিমালার কাজ। সারাবিশ্বে শুধু ২০১৬ সালে অলঙ্কার রফতানি হয়েছে ৬৩৮ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই হস্তনির্মিত অলঙ্কারের প্রায় ৮০ শতাংশই ভারত এবং বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। রফতানি ব্যুরো উন্নয়নের পরিসংখ্যান মতে বাংলাদেশ ৬৭২ মার্কিন ডলার এবং ভারত রপ্তানি করেছে ৪২ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই হিসেবে আমাদের অবস্থান অনেক নিচে। তবে আমাদের দেশের শ্রমিক ভারতে গিয়ে স্বর্ণ তৈরি করে বেশি। নীতিমালা অনুযায়ী স্বর্ণালঙ্কার আমাদানির ক্ষেত্রে অনুমোদিত ডিলারের মাধ্যমে স্বর্ণবার আমদানির নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে। অনুমোদিত ডিলার নির্বাচনের কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্পন্ন করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই উদ্দেশে গাইডলাইন দিয়ে দাম নির্ধারণ করে দেবে। অনুমোদিত ডিলার সরাসরি স্বর্ণবার আমদানি করতে পারবে এবং এ স্বর্ণবার অলঙ্কার প্রস্তুতকারকদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। তৈরি অলঙ্কার বিদেশে রপ্তানি করা হবে। স্বর্ণালঙ্কার বিক্রি করার ক্ষেত্রে হলমার্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে ।
বহুদিন দেশে কোনো স্বর্ণ নীতিমালা ছিল না। সেজন্য এ খাতে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল। স্বর্ণ আমদানির নামে আমদানি হতো না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্মাগল হতো। এসব ব্যবস্থা একটি নিয়মের আওতায় আনার জন্য স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করে এদেশের ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে মূল্য সংযোজন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারবে। এই নীতিমালার আলোকে দেশের স্বর্ণ খাতের সম্পূর্ণ ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নীতিমালার অভাবে দেশের স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান এবং স্বর্ণবাজারের ওপর স্বর্ণব্যবসায়ীদের যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নীতিমালাটি প্রণয়নের ফলে তা লাঘব হওয়াসহ অবৈধ স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের আমদানি বন্ধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকারের মান যাচাই, ক্রেতা-বিক্রেতার স্বার্থ সংরক্ষণ এবং স্বর্ণশিল্পী বা শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার যে ঘাটতি ছিল সেটাও নিরসন করা সহজ হবে
প্রতীয়মান হয় অভ্যšতরীণ চাহিদা মিটিয়ে স্বর্ণের বাণিজ্যকে নিয়মের আওতায় আনার উদ্দেশে এ নীতিমালা করা হচ্ছে। স্বর্ণ আমদানির পর ‘ভ্যালু অ্যাড করে’ আবার তা রপ্তানি করার সুযোগ থাকছে এই নীতিমালায়। এটার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একটা রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক হচ্ছে। এটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – বাংলাদেশ ব্যাংক ডিলার নিয়োগ করবে, যাদের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানি হবে। অনুমোদিত ডিলার সরাসরি স্বর্ণের বার আমদানি করতে পারবে। তবে ডিলার স্বর্ণের বার ছাড়া কোনো স্বর্ণালংকার বা অন্য কোনো ভাবে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবে না। স্বর্ণের বার আমদানির সময় ডিলার বন্ড সুবিধা নিতে পারবে। এসব ডিলার স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বর্ণের বার বিক্রি করবে। ফলে বৈধভাবে ব্যবসাটা ভালোভাবে চলতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি তথ্য ভান্ডার থাকবে।
স্বর্ণ আমদানিতে বন্ড সুবিধাও থাকছে। আমদানি করে দেশের ভেতর অলংকার বানিয়ে তা বিদেশে রপ্তানি উন্মুক্ত করতে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের রপ্তানিকারকদের নগদ প্রণোদনা সহায়তাসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমিও বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। এছাড়া অলংকার তৈরি করে যারা দেশের মানুষের কাছে বিক্রি করবে, তারাও আমদানি করা স্বর্ণ ব্যবহার করতে পারবে। নিবন্ধিত বৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বর্ণালংকার রপ্তানিকারক সনদ নিতে পারবে। বৈধভাবে স্বর্ণালংকার রপ্তানি উৎসাহিত করতে রপ্তানিকারকদের স্বর্ণালংকার তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতসহ বিভিন্ন প্রকারের প্রণোদনামূলক বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে। স্বর্ণালংকার রপ্তানির উদ্দেশে আমদানি করা স্বর্ণেও ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র-ব্যাক ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়া হবে।
নীতিমালায় পুরনো স্বর্ণ কেনাবেচায় স্বচ্ছতা আনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকের কাছ থেকে রিসাইকেল্ড বা পুরনো স্বর্ণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্রাহক, বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোট্রের কপি এবং পূর্ণাঙ্গ যোগাযোগের ঠিকানা সংরক্ষণ করতে হবে। সরকার স্বর্ণের মান নির্ণয়, যাচাই ও নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব মান প্রণয়ন করবে। স্বর্ণের মান যাচাই ও বিশুদ্ধ স্বর্ণের পরিমাণ যাচাই নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর ল্যাব টেস্ট, ফায়ার টেস্ট বা হলমার্ক টেস্ট সুবিধাসহ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করা হবে।
নীতিমালার অভাবে অনিয়মগুলোই কার্যত অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছিল যা ছিল স্বর্ণ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বর্ণ নীতিমালার কঠোর এবং সতর্ক বাস্তবায়ন এই অবস্থার অবসান ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এতদিনের সুবিধাভোগী কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে এবং নীতিমালা থেকে বিচ্যূতির যে কোনো সম্ভাবনা শুরুতেই প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী মহলসহ সকল অংশীজন কর্তৃক নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। এজন্য প্রয়োজন সকল পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রশাসনিক ও ব্যবসায় খাতে কঠোর শুদ্ধাচারের চর্চা। একই সাথে নীতিমালাটির যথাযথ বাস্তবায়নে স্বর্ণখাতের জন্য এই নীতিমালার আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন করতে হবে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান