বিশেষ সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মিহির দেব আগরতলা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ‘ওয়ার ক্যাপিটাল’
প্রিয়াংকা আচার্য্য : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। দেশটির আপামর জনগণ বিভিন্নভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মুখোমুখি হয়েছিলাম বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ মিহির দেবের। একাত্তরে তিনি আগরতলা মহারাজা বীর বিক্রম কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। জন্ম পূর্ববাংলায় হলেও তা ছেড়ে আসতে হয়েছিল। কিন্তু সবসময়ই টান অনুভব করেন পূর্ববাংলার প্রতি। শোনালেন মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা ও সেখানকার মানুষের বন্ধুতার কথা।
আগরতলা ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ‘ওয়ার ক্যাপিটাল’। আগরতলা খুব স্ট্র্যাটেজিক্যালি ইনভল্ব ছিলো এ যুদ্ধে। বাংলাদেশের মানচিত্র খেয়াল করলে দেখবেন, ত্রিপুরা একটা গোঁজের মতো সেখানে ঢুকে গেছে। ধর্মনগর থেকে শুরু করে সাব্রুম পর্যন্ত প্রায় ৯শ কিলোমিটার সীমান্ত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শচীন্দ্র সিংহ। দুজনেই বাংলাদেশকে সার্বিক সহায়তা দিতে সম্মত। ইন্দিরা গান্ধী সকল সীমান্ত খুলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ ভয়ে আশ্রয়ের জন্য ভারতে আসতে লাগলো।
আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা তাজউদ্দিন আহমেদসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতাই ২৫ মার্চের পর আগরতলা চলে আসেন। আগরতলার সার্কিট হাউজে বসেই নেতারা ১০ এপ্রিল ঘোষিত মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার তালিকা করেন। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে, সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে। তখন কুষ্টিয়ার মেহেরপুর (বর্তমান মুজিবনগর) পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কড়াল মুক্ত থাকায় ১৭ এপ্রিল সেখানেই মুজিবনগর সরকার শপথের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ধীরে ধীরে শরণার্থী শিবির গড়ে উঠতে লাগলো। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং শুরু হলো। পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে লাঠি হাতে ট্রেনিং নিতে দেখেছি অনেককে। পরে অস্ত্র এসেছে। শুরুতে এখানকার ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী তাদের ট্রেনিং দেয়া শুরু করলেন। আমরা খবর পেতে থাকলাম সব ফ্রন্টে মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে শুরু করেছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকতো হাসপাতাল। লন্ডন থেকে দুজন ডাক্তার মেলাঘরে হাসপাতাল খুললেন। সেখানে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হতো।
তখন ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার সমান শরণার্থী এসেছিল। এটা ভেবে অবাক লাগে যে, ত্রিপুরায় এমন একটি ঘটনারও উল্লেখ নেই যেখানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগতদের সাথে ত্রিপুরার লোকেদের সংঘাত হয়েছে। শুধু বাঙালিরাই নয় ত্রিপুরার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরাও পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের পক্ষে ছিল। এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য এই যে, ত্রিপুরা পার্শ¦বতী সিলেট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটির নাম একসময় ছিল চাকলা রৌশানাবাদ। যা ত্রিপুরা রাজার অধীনে ছিল। প্রায় আড়াইশ বছর আগে প্রথমে ঢাকার নবাব পরে ব্রিটিশরা এটা দখল করে। কিন্তু শর্ত ছিল চাকলা রৌশনাবাদে রাজত্ব না হলেও ত্রিপুরা রাজার জমিদারী থাকবে। আমরা সেই জমিদারিতে বাস করেই ত্রিপুরা রাজাকে খাজনা দিতাম। এখানে যারা বিত্তশালী তারা পশ্চিবঙ্গে পাড়ি জমান। আর সাধারণদের বৃহৎ অংশ এখানে থেকে যায়।
৯ মাস আগরতলা ছিল ওয়ারফিল্ডের ভেতরে। কিছুদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পর আমরা স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে থাকি। আগরতলার সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ঘরের নারীরাও তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সহায়তা করেছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তারা রান্না করে খাইয়েছে, তাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ করেছে। মেলাঘরের লোকজন প্রত্যক্ষভাবে এ যুদ্ধে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। সবাই মিলে আমাদের ভাবটা ছিল এমন যে যুদ্ধটা আমাদেরও।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কয়েকটি দায়িত্ব পালন করেছি। সিভিল ডিফেন্সে কাজ করায় আমার ওপর কিছু দায়িত্ব ছিল। এছাড়া লেখালিখি ও সভা-সমিতি করে পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতাম। তবে গুরু দায়িত্বটি ছিল দৈনিক সংবাদের অফিসে। অফিসটি তখন ঢাকার সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। সেখানে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ হতো।
আমি একটি রেডিও নিয়ে সেই অফিসে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ঘুরাতাম। ২৬ মার্চ এভাবেই আমরা প্রথম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কথা জানি। আপনারা তো জানেন শর্ট ওয়েবে টেলিফোনের কথোপকথনও ধরা পড়ে। আমি অনেক হৃদয়বিদারক মেসেজ সেখানে পেয়েছি। একজন আর্মি অফিসার তার স্ত্রীকে বলছে- তুমি নেক্সট ফ্লাইটে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে করাচি চলে যাও। আল্লাহর কৃপায় ফিরলে তোমার সাথে আবারও দেখা হবে। এছাড়া শত্রুদের পজিশন কোথায় কোথায় তাও মাঝে মাঝে শুনতে পেয়ে আমি দৈনিক সংবাদের সম্পাদক ভূপেন দত্ত ভৌমিককে জানাতাম। তিনি তথ্যগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন।
সেসময় আগরতলার পত্রিকাগুলোয় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ খবরই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে থাকতো। যে পত্রিকা কুড়ি হাজার ছাপা হতো সেটা যুদ্ধ চলাকালে ৫ থেকে ৬ দফায় প্রায় ৮০ হাজারের মতো ছাপা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও ওপার থেকে আসা বাঙ্গালিদের কাছে সেগুলো পৌঁছে দেয়া হতো।
সাংবাদি অনীল ভট্টাচার্য। তার নেটউয়ার্ক ছিল দুর্দান্ত। ২৪ ঘণ্টা তার বাড়ির উনুন জ্বলতো। বৌদির কাছে গিয়ে খাবার চাইলেই তিনি সময় যতোই হোক ভরপেট খাইয়ে দিতেন। গায়ক অজয় রায় তরুণদের নিয়মিত গান শেখাতেন যাতে তারা উজ্জীবিত হয়ে ফ্রন্টে সেই উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে পারে।
আত্মসমর্পণের ৩ থেকে ৪ দিন আগে থেকেই রেডিও তে আসছে- ‘আমি জেনারেল মানেকশ বলছি, নিয়াজী তুমি কথা শোনো, আমি তোমাকে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ঘেরাও করে রেখেছি তুমি কোনো দিক দিয়ে বের হতে পারবে না।’ ত্রিপুরা একদল সাংবাদিক তখন সড়ক পথেইঢাকার দিকে রওনা দেয়। তারা ভুলে গিয়েছিল যুদ্ধের কারণে সেতু ও সড়ক ব্যবস্থার জীর্ন অবস্থার কথা।
১৫ ডিসেম্বর বিকচ চৌধুরী নামে এক তরুণ সাংবাদিককে আমি বলি, এই নাও টাকা আর ব্যাগ। কাল তোমাকে যে করেই হোক ঢাকা যেতে হবে। বিমানবন্দরে গিয়ে ব্যবস্থা করো। আগরতলার বিমানবন্দরটি তখন সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল। সেখানে এক ক্যাপ্টেনকে ম্যানেজ করে বিকচ ঢাকায় পৌঁছে। ত্রিপুরার সাংবাদিক হিসেবে বিকচই সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণের দিন ঢাকায় পৌঁছে।
পরিশেষে বলি, একটা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িত হওয়ার চেয়ে গৌরব আর কিছু নেই। আমরা সেখানে নিঃস্বার্থভাবে পাশে থাকতে পেরে গর্বিত।