ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে মূল বাধা কি গুণগত মান
আবুল বাশার
প্রতি বছর সাড়ে ১৬ শতাংশ হারে বাড়ছে ওষুধ শিল্পের বাজার। ২০১৮ সালে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে এর আকার। তবে অভ্যন্তরীণ বাজার যে হারে বাড়ছে, সে তুলনায় কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি নেই রপ্তানিতে। প্রায় ১ লাখ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক ওষুধ বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুব সামান্যই। গত অর্থবছরে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এ অবস্থায় ওষুধের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে গুণগত মান বড় বাধা কিনা, সে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মান নয়, নীতিনির্ধারণী দুর্বলতাই দেশের ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি শুরু হয় প্রায় দুই দশক আগে। দীর্ঘ এ সময়ে ধীরগতিতে বেড়েছে রপ্তানি, যদিও অভ্যন্তরীণ বাজার বেড়েছে দ্রæতগতিতে। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ১০ কোটি ৩৪ কোটি ডলারের ওষুধ। বর্তমানে প্রায় ১৫০ দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। ১০০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করার সক্ষমতা রাখলেও রপ্তানিতে সক্রিয় প্রায় ৪৬টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক পণ্য আছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্ত।
ওয়ার্ল্ডসটপএক্সপোর্টসডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বিশ্ববাজারে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বেশি। যদিও এ রপ্তানির বড় অংশই করেছে উন্নত দেশগুলো। ওষুধের শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে—জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও প্রতিবেশী দেশ ভারত। বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭১তম।
ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে নীতিদুর্বলতার পাশাপাশি পণ্যের মানে কোনো ঘাটতি আছে কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। কারণ বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিম্নমানের অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট (এপিআই) ব্যবহারের অভিযোগ আছে বহু আগে থেকেই। বিশেষ করে ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) সতর্কবার্তা পাওয়া চীনা প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের এপিআই আমদানির অভিযোগ রয়েছে দেশের স্বনামধন্য একাধিক ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে। তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ওষুধ পণ্যের উৎপাদন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া এখনো অভ্যন্তরীণ বাজারকেন্দ্রিক। এজন্য রপ্তানি কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি বাড়াতে হলে নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হবে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা ওষুধের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই জানালেও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সময় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ জব্দ হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অভিযানে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সারা দেশে নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৯টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) গাইডলাইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করায় এবং ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে বিভিন্ন সময় ৮৬টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স সাময়িক বাতিল করা হয়। অন্যদিকে লাইসেন্স চিরতরে বাতিল করা হয় ১৮টি প্রতিষ্ঠানের।
তবে ওষুধের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নারাজ এ খাতের বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলছেন, পণ্যের মান রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় বাধা কখনই ছিল না। বিশেষ করে বড় বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু শর্ত আছে, যেগুলো আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো পূরণ করতে পারে না। কিছু কারিগরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয় আছে, যেগুলো আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেশের বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হয়, যা সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সম্ভব না। রপ্তানি গন্তব্যে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করার প্রয়োজন হয়। এগুলো নীতিনির্ধারণী বিষয়। দেশভেদে এ নীতিগুলোয় পার্থক্যও দেখা যায়। ঔষধ প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বায়োইকুইভ্যালেন্সের মতো সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সরকার এরই মধ্যে উদ্যোগী হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরীক্ষাগারও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রপ্তানি বৃদ্ধিতে সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করতে সব প্রচেষ্টা সরকার অব্যাহত রেখেছে। সার্বিক বিষয়ে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, ওষুধ পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে বড় ধরনের কোনো নীতিনির্ধারণী সমস্যা আছে বলে আমার জানা নেই।
যতটুকুই আছে, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সরকারি ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তনও সরকার করছে। পর্যায়ক্রমে রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে ওষুধের রপ্তানি আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। (বণিক বার্তা থেকে)