টেংরার কৃত্রিম চাষাবাদের কৌশল
ইয়াছির আরাফাত
মাছের নাম টেংরা। নামটি অদ্ভুত, কিন্তু খেতে সুস্বাদু। অন্যান্য মাছের তুলনায় টেংরায় কাঁটা কম হওয়ায় অনেকের কাছে বেশ প্রিয়। একসময় খালবিলসহ বিভিন্ন জলাশয়ে এ মাছ দেখা যেত। খালবিল কমে যাওয়া ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে এর প্রজনন বৃদ্ধি না পেয়ে বরং হ্রাস পেয়েছে। অথচ পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এ মাছকে বাঁচিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য টেংরার কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে চাষ করে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব। টেংরা চাষের জন্য কিছু কৌশল ও পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়।
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুুতি : টেংরা চাষযোগ্য পুকুরের আয়তন হতে হবে অন্তত আট থেকে ১০ শতাংশে। এর গভীরতা হবে এক মিটার। মাছ ছাড়ার আগে পুকুরটি শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনো পুকুরের প্রতি শতাংশে এক কেজি হারে চুন দিতে হবে। চুন দেওয়ার পাঁচ থেকে ছয় দিন পর ইউরিয়া, টিএসপি ও গোবর সার ব্যবহার করতে হবে। পানি দেওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর পোনা ছেড়ে দেওয়া যাবে।
কৃত্রিম প্রজননের কৌশল : টেংরার প্রজননকাল এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত। কৃত্রিম প্রজননের আগে কোনো খালবিল বা পুকুর থেকে পরিপক্ব পুরুষ ও স্ত্রী মাছ তুলে সিমেন্টের তৈরি সিস্টার্নে অথবা ফাইবার গøাস ট্যাঙ্কে প্রায় এক দিন রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ সময় মাছগুলোকে কোনো খাবার দেওয়া যাবে না। সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝরনা ব্যবহার করতে হবে। টেংরার স্ত্রী ও পুরুষÑউভয়কে পিটুইটারি গø্যান্ড (পিজি) অথবা ওভাটাইড বা ওভাপ্রিম হরমোন পাখনার নিচের অংশে ইনজেক্ট করতে হবে। এ ইনজেকশন দেওয়ার পর হাপায় ১:২ অনুপাতে স্ত্রী ও পুরুষ রাখতে হবে। প্রতিটি হাপায় দুই থেকে তিনটি করে স্ত্রী মাছ রাখা যেতে পারে। প্রজননকালে আশপাশের পরিবেশ কোলাহলমুক্ত রাখতে হবে। মাছে হরমোনের ইনজেকশন সন্ধ্যায় দেওয়াই শ্রেয়। হরমোন প্রয়োগ করার আট থেকে ৯ ঘণ্টা পর হাপাতেই স্ত্রী টেংরা ডিম ছাড়ে। ডিম আঠাল অবস্থায় হাপার চারপাশে লেগে যায়। ডিম দেওয়ার পর হাপা থেকে ব্রæডগুলো সরিয়ে নিতে হবে। ডিম ছাড়ার ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর ডিম ফুটে রেণু বের হয়। রেণুর ডিম্বথলি নিঃশেষিত হওয়ার পর রেণুকে খাবার দিতে হবে। হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে সপ্তাহব্যাপী রাখার পর চাষযোগ্য পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
টেংরা চাষে সম্ভাবনা : বাংলাদেশের মৎস্য খাত সম্ভাবনাময়, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অন্যান্য মাছের পাশাপাশি টেংরা উৎপাদন করেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করা সম্ভব। টেংরার কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে মৎস্যচাষিদের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করা যেতে পারে। এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগও নেওয়া যেতে পারে। বাজারে এর মূল্য অন্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। এ মাছ চাষ করতে পারলে তুলনামূলকভাবে বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। ফলে হ্যাচারি ও পুকুর মালিকদের আয় বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
বিভিন্ন প্রজাতি ও বিবরণ : সাধারণ টেংরার পিঠের দিক পিঙ্গল রঙের হয়। পেটের দিক সাধারণত সাদাটে হয়ে থাকে। শরীরের পাশে ও নিচে লম্বালম্বি দুটি ব্যান্ড রয়েছে। এগুলো হালকা রঙের। এটি দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ১৪ সেন্টিমিটার হয়। গোলসা টেংরা : পার্শ্বরেখার ওপরে গাঢ় রঙের দুটি চ্যাপ্টা ও নিচে দুটি সরু ব্যান্ড রয়েছে এ প্রজাতির। ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে গোলসা টেংরা। গুলি টেংরা : গুলি টেংরার পিঠের দিক পিঙ্গল বর্ণের। পেটের দিক ফ্যাকাশে সাদা। এর চোয়ালের স্পর্শী আংশিক কালো। দৈর্ঘ্যে সর্বোচ্চ ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। কাবাসি টেংরা : এ ধরনের টেংরার পিঠের কাঁটার গোড়ায় কালো দাগ থাকে। এটি লম্বায় ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। বজুরি টেংরা : বজুরি টেংরার রঙ পিঙ্গল। কানের পেছনে কালো দাগ রয়েছে। এর শরীরে লম্বালম্বি কয়েকটি দাগ রয়েছে। এটি দৈর্ঘ্যে ছয় সেমি পর্যন্ত হয়।