কী আছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির পেছনে
আবুল বাশার
গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছিল। ধারাবাহিকভাবে দুই বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের ওপর ছিল। চলতি অর্থবছরেও ৭ শতাংশের ওপর প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সরকারের বাজেট দলিল হিসেবে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতে বর্তমান হারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশাবাদী হতে নিশ্চয়তা দিতে পারে। দেশের অর্থনীতির এ প্রবৃদ্ধি থেকে প্রতিপন্ন হতে পারে যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা খুব জোরালো না হলেও বেড়েছে। তবে অন্যান্য সূচক পর্যালোচনা আগামীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে বলে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে সন্তোষজনক রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি, রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্সপ্রবাহ ফিরে আসার বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। মিডিয়াম টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কের (এমটিএমএফ) অধীন চলতি অর্থবছরে প্রক্ষেপিত জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের উপরেই আছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিচক্ষণ আর্থিক ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন, দক্ষ ও কার্যকর মুদ্রানীতি প্রয়োগ, সুষ্ঠু ব্যয় ব্যবস্থাপনা ও সংস্কার কার্যক্রমের যথার্থ সম্পাদন নিশ্চিত করা হবে বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
জিডিপিতে ভোগ্য ব্যয়ের অংশ বেড়ে ৭৭ শতাংশের উপরে এসেছে। জিডিপির অন্যতম স্তম্ভ অভ্যন্তরীণ চাহিদা উপরে উঠেছে, যাা বিনিয়োগে চাহিদার ইঙ্গিত হতে পারে। এদিকে দেশজ ও জাতীয় সঞ্চয় কমে এসেছে। অন্যদিকে বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত পূর্ববর্তী বছরে থেকে কিছুটা বেড়েছে। সরকারি বিনিয়োগ থেকে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হলেও বৃদ্ধির হার কম। বিনিয়োগ প্রসারের লক্ষ্যে বরাবরের অর্থনৈতিক সমীক্ষার মতো নীতিমালা প্রণয়ন, আইন ও বিধিগত সংস্কার, সহায়ক পরিবেশ জোরদারকরণ, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, অবকাঠামো উন্নয়ন, দ্রæত বিদ্যুতায়ন, উন্নত তথ্য ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যাপক পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে বলে বর্ণনা করা হলেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে মূল্যসূচক কমেছে, যদিওবা বাজার মূলধন ১ শতাংশের উপরে বৃদ্ধির তথ্য দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মূল্যসূচক ও বাজার মূলধনের পরিমাণ বেড়েছে যথাক্রমে ৬ শতাংশের ওপর ও ৮ শতাংশের কাছাকাছি। এ স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধনের পরিমাণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তুলনায় অর্ধেকের ওপর।
রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরে বেড়েছে। এর আগের অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমেছিল। গত অর্থবছরে উন্নীত হলেও বৃদ্ধির হার দুই বছর আগের এমনকি চলতি দশকের প্রথম দিকের তুলনায় কম থেকে গেছে। তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যার রপ্তানি বাবদ আয় বেড়েছে। এ দুটি শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানি আয় ছিল মোট রপ্তানি আয়ের চার-পঞ্চমাংশের ওপর। এ হিস্যার পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গত অর্থবছরে বৃদ্ধির হার চলতি দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল। রপ্তানি আয়ে তৈরি পোশাক ও নিটওয়্যারের গুরুত্ব আরো বেড়েছে। পাটজাত পণ্য রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। অন্যদিকে চা, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া, জুতা রপ্তানি থেকে আয় চলতি দশকের শুরুর তুলনায় কমের দিকে। লক্ষণীয়, জোরালো অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে আমদানি ঊর্ধ্বগামী হয়েছে। অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদনের অন্যতম উপাদান পেট্রলজাত সামগ্রী ও মূলধনি যন্ত্রপাতির অধিকতর আমদানিতে মোট আমদানি ব্যয় বেড়ে চলেছে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে গেলে এবং অধিকতর মূলধনি যন্ত্রপাতি ও খাদ্য আমদানি চলতি হিসাবে ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
দেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি থেকে প্রতিপন্ন হতে পারে যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রসারে আমদানি বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদনের অন্যতম উপাদান পেট্রলজাত সামগ্রী ও মূলধনি যন্ত্রপাতির অধিকতর আমদানিতে মোট আমদানি ব্যয় বেড়ে চলেছে। নিয়মিত কর্মসংস্থানে নিয়োজিত কর্মীর হার বেড়েছে। এ বৃদ্ধির হার দেশের বেকার দূরীকরণে যথেষ্ট কিনা, পর্যালোচনার বিষয় হতে পারে। সেই সঙ্গে গড়ে প্রকৃত মাসিক আয় বৃদ্ধির হারও গবেষণা করে দেখার প্রয়োজন থাকতে পারে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির তুলনায় বেতন, মজুরি ও আয় পারিবারিক ব্যয় নির্বাহে সর্বনিম্ন চাহিদা পূরণে যথেষ্ট কিনা। কৃষি, খনিজ, খনন, বিদ্যুৎ, নির্মাণ, পানি ও গ্যাস, পণ্য, ব্যক্তিগত সেবা খাতে শ্রমশক্তির হার কমেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং চলতি দশকের মাঝামাঝি বেশ কমে পরবর্তী জরিপে সামান্য বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, সংরক্ষণ, যোগাযোগ, অর্থ, ব্যবসা, সেবা, জনপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা খাতে বৃদ্ধির তথ্য দেয়া হয়েছে। স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রসার কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে একটা সম্ভাবনাময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহারে প্রযোজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ একান্তই প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের জোরদার প্রচেষ্টা আবশ্যক। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর দক্ষ আর্থিক খাত তৈরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশের বিস্তৃতি এবং সুশাসন জোরদারকরণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মজীবী তৈরি করে চাকরির প্রত্যাশা পূরণে শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। প্রবৃদ্ধি অর্জনে অগ্রগতি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হয়েছে। তার পরও চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি যেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর হয়ে ওঠে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ না হয়ে পড়ে। সামাজিক খাতগুলোয় বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নে সরকারের বাজেট বরাদ্দের অংশ বা বৃদ্ধির হার উন্নীত করাও জরুরি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এসব বিষয়, বিশেষভাবে সম্ভাবনা ও ঝুঁকিগুলো পর্যালোচনা আগামীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয় ব্যবস্থাপনা গ্রাম-শহরসহ সারা দেশে সাধারণ মানুষের কল্যাণে অধিকতর সহায়ক হতে পারে। কিউ আর ইসলাম: উন্নয়ন গবেষক