অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মূলধারায় হিজড়া সম্প্রদায়
আবুল বাশার
জš§গতভাবে যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে এই জনগোষ্ঠী হিজড়া হিসেবে পরিচিত। তাদের সম্পর্কে কোনো ধরনের সঠিক তথ্য আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত এমনকি অনেক ডাক্তাররা পর্যন্ত দিতে পারেন না। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত প্রজনন ও লিঙ্গ নির্ধারণভিত্তিক কথাবার্তা খুব ভীতিসহ এবং গোপনে আলোচনা করা হয়, যার কারণে এ রকম ব্যাপারগুলো খুবই স্পর্শকাতর বলে ভাবা হয়। ফলে আমরা দ্বিধাদ্ব›েদ্ব থাকি।
সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপমতে, বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। কোনো কোনো এনজিওর হিসাবে এ সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিত মাত্র দুই শতাংশের কিছু বেশি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। অনেকে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত। সমাজে তারা প্রতিনিয়ত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হয়। নিজ পরিবারেও তারা অচ্ছুত ও অনাদৃত। বাংলাদেশের উত্তরাধিকার আইন এখনও নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারে না। বেশিরভাগ হিজড়াই কোনো সম্মানজনক জীবিকায় নেই। ভিক্ষা, যৌনকর্ম ও চাঁদাবাজিই তাদের মূল পেশা। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ না থাকা, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনীহা এমন নানা কারণে হিজড়ারা বাধ্য হচ্ছে এ ধরনের কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিজড়াদের শান্তিপূর্ণ একটি জনগোষ্ঠী মনে করে না। মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলার সংস্কৃতিতে হিজড়ারা অভ্যস্ত হয়েছে।
হিজড়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমান কাল ধরে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সব নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতীয়মান। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষাসংক্রান্ত, বাসস্থানগত ও স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি তাদের সমাজের মূলস্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূলত স্কুলগামী হিজড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে উপবৃত্তি প্রদান; প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয় বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোতধারায় আনা; হিজড়া জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা এবং পরিবার ও সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে এ কর্মসূচি ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় মোট বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
যেকোনো জাতির উন্নয়নে শিক্ষা জরুরি। আর তাই হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপবৃত্তি চালু করেছে সরকার। সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে শনাক্তকৃত হিজড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শ্রেণিবিন্যাসে চারটি স্তরে বিভক্ত করে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। প্রাথমিক স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি মাসিক ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি মাসিক ৮০০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি মাসিক এক হাজার টাকা এবং স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জনপ্রতি মাসিক এক হাজার ২০০ টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা প্রদান কর্মসূচির আওতায় দুই হাজার ৫০০ হিজড়াকে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে বিশেষ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয় বর্ধনমূলক কাজে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূলস্রোতধারায় আনার লক্ষ্যে ৫০ দিন করে তাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রত্যেককে প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা বাবদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। এখন পর্যন্ত সাত হাজার ৬৫০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের পর সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১০ জেলায় হিজড়াদের জন্য আবাসনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
২০১৩ সালের নভেম্বরে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাদের ভোটাধিকারও দেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিলেও এতদিন জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট গ্রহণ করার ক্ষেত্রে হিজড়াদের হয় নারী নয়তো পুরুষ লিঙ্গ বেছে নিতে হতো। চলতি বছরের ১১ এপ্রিল ভোটারতালিকা নিবন্ধন ফরমের (ফরম-২) ক্রমিক নং-১৭ সংশোধন করে লিঙ্গ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘পুরুষ’ ও ‘মহিলা’র পাশাপাশি ‘হিজড়া’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা হিজড়াদের জন্য এযাবৎকালের সবচেয়ে বড়ো স্বীকৃতি। সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় ট্রাফিক পুলিশে তাদের চাকরি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। অপরদিক, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারের আইসিটি বিভাগ তাদের তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
যুগান্তকারী এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ সম্প্রদায়ের একটা বড় দাবি হলো উত্তরাধিকারের স্বীকৃতি। যে বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে তারা জš§ নিয়েছে, সে বাবা-মায়ের আদর-স্নেহ-সম্পত্তিÑসবকিছুতেই তাদের অংশ নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, হিজড়াদের অন্তর্ভুক্ত করলে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজতর হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পিআইডি প্রবন্ধ