সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ব্রজ গোপাল রায় বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় আমরা নেতাজির কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম
প্রিয়াংকা আচার্য্য : শিক্ষাবিদ ব্রজ গোপাল রায় ছিলেন ত্রিপুরার প্রাক্তন মন্ত্রী। বয়স ৮২। আগরতলা শহরে মেয়ের সঙ্গে নিজবাড়িতে থাকেন। লেখালিখি করেন। শিক্ষকতা করতেন। একাত্তরে রাজ্যের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। উপরন্তু নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর রাজনীতিক দল ফরোয়ার্ড ব্লকের ছিলেন সক্রিয় কর্মী। গত ২৯ নভেম্বর ওনার বাড়িতে বসে শুনলাম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
‘বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল একাত্তরে। ত্রিপুরায় আমরাও তখন সেই উত্তেজনার আগুন পোহাতাম। আমাদের মনে হতো, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষা ও বাঙালির মর্যাদা রক্ষা এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেটা তার একার যুদ্ধ নয়, সেখানে আমরাও জড়িত হয়ে গিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা, তাদের মৌখিক সহানুভূতি জানানো, তাদের উৎসাহিত করা, পত্র-পত্রিকায় লেখালিখি করা থেকে শুরু করে যতোটা সম্ভব আমরা করেছি।’
‘শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা আমাদের কাছে মনে হতো আমরা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি। নেতাজী যেমন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করবার জন্য সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন, তেমনই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বাঙালিকে স্বমহিমায় জেগে উঠার স্বপ্ন দেখালেন। বাঙালি কারও আনুগত্য মানে না, বাঙালি এগিয়ে যাবে, দেশকে স্বাধীন করবে। ৭ মার্চের ভাষণে বলেছেন- দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’
‘যুদ্ধ শুরু হলে আমরা পাকিস্তানীদের বর্বর অত্যাচারের অনেক নৃশংসতা আমরা দেখেছি। অনেক নারী তাদের ইজ্জত খুইয়েছেন, অনেকে কোলের বাচ্চা প্রাণ ভয়ে ফেলে এসেছেন। এটাই আমাদের বিশেষভাবে উত্তেজিত করেছে যে, এ বর্বরতার অবসান হওয়া দরকার। মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে এখানে আশ্রয় নিতে এলে ত্রিপুরার মানুষ দেখলো এতো আত্মীয়েরই যন্ত্রণা।’
‘কারণ এখানকার অধিকাংশ লোকের তখন মাতৃভূমি ছিল পূর্ব বাংলায়। আমাদের ভাষা এক। সংস্কৃতিও এক। দেশভাগের ফলে এপারে চলে আসা। তাই এখানকার প্রত্যেকেই একাত্তরে ওপাড় থেকে আসা মানুষের পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে থাকে। পাশাপাশি ভারত সরকার বাংলাদেশকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন করায় লড়া য়ে প্রস্তুতিটা এখান থেকেই চলতো।’
‘আমি তখন প্রাচ্যভারতী হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করতাম এবং আর ছিলাম ফরোয়ার্ড বল্ক পার্টির ত্রিপুরার যুব শাখার প্রেসিডেন্ট। এখানে আসা অনেক বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষককে আমরা কাজ দিতে সহায়তা করেছি। ছাত্রদের কি করে কাজে লাগানো যায় তার পরিকল্পনা করতাম।’
‘পার্টির পক্ষ থেকে আমরা ঠিক করলাম যারা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আমাদের এখান থেকে প্রস্তুত হয়ে বের হবে তাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য চা পাণ করাবো। তো সীমান্তের কাছে জায়গা ঠিক হলো। আমরা সেখানে নিয়ম করে বসতাম। যারা যুদ্ধে যেতো তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলতাম। চা খাওয়াতাম। তারাও আমাদের সঙ্গে খানিক গল্প করতো। এরপর নিজেদের গন্তব্যে চলে যেতো। অনেকেই অ্যাকশন শেষে ফিরে আসতো। অনেকে আসতো না। তখন আমরা বুঝতাম তারা আর নেই।’
‘দৈনিক অগ্রগতির অফিসে তখন দুই পাড়ের মানুষদের আশা যাওয়া ছিল। কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, দারোগা থেকে শুরু করে সবাই এখানে আসতো। পত্রিকার সম্পাদক নেপাল দে ছিলেন সেসব আড্ডার মধ্যমণি। তিনি সবাইকে চা খাওয়াতেন। বিভিন্ন ধরনের সংগ্রহ করতেন। সেখানেই বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন আইজউদ্দি নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। উনার কাছ থেকে রণাঙ্গাণের অনেক চমকপ্রদ তথ্য আমরা পেতাম।’
‘শরণার্থীদের সহায়তায় আমরা নানা জায়গা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করতাম। আমাদের পার্টি অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড বল্কের পক্ষ থেকে এসেছিলেন নির্মল বসু। বাংলাদেশের দুজন নেতারা হাতে তিনি সংগ্রহকৃত অর্থ তুলে দিয়েছিলেন। এছাড়া ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ থেকে রাস্তায় রাস্তায় জাগরণী গান গেয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। সাহায্য সংগ্রহ করে ত্রাণ তহবিলে দিয়েছি।’