কর্নেল (অব.) অশোক তারা বীরচক্র ১৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে মুক্ত করে সেখানে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়াতেই নিচে পড়ে থাকা পাকিস্তানি পতাকাটি পদদলিত করে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বললেন ‘জয় বাংলা’
প্রিয়াংকা আচার্য্য : কর্নেল (অব.) অশোক তারা বীরচক্র বর্তমানে দিল্লীতে থাকেন স্ত্রীর সঙ্গে। সৌম্যদর্শন এই বলিষ্ঠ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। তিনি সেসময় ১৪ গার্ড রেজিমেন্টের হয়ে মিজোরাম ছিলেন। পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলে আগরতলা সীমান্তে চলে আসেন। শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প বানানো থেকে শুরু করে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেয়াসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারত সরকার তাকে বীরচক্র সম্মাননায় ভূষিত করে। গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লীতে তার বাসায় এ সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। মূল সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে নিলেও পাঠকদের সুবিধার্থে তা বাংলায়ন করা হলো।
১৬ ডিসেম্বর মধ্য রাতে আমি যখন বিশ্রাম করছিলাম তখনই আমার কাছে মেসেজ আসলো। ঢাকা বিমানবন্দরে কিছু ভিআইপি আসছেন। বিমানবন্দর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। পরদিন ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা নাগাদ আমার সহকর্মী মেজর খান্নার সঙ্গে এয়ারপোর্টে নিরাপত্তা জোরদার কাজ করার সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা এলেন। তিনি কমান্ডিং অফিসারকে জানালেন, ব্যাপক হুমকির মুখে রয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। এখনই ব্যবস্থা নেয়া না হলে, তাদের যেকোনও সময় হত্যা করা হতে পারে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপস্থিত আমরা কেউই তখনও অনুধাবন করতে পারিনি। আমার কমান্ডিং অফিসার বললেন, অশোক যাও সমস্যার সমাধান করে এসো।
নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আমি দুজন জওয়ানকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলাম। খবর এনে দেয়া সেই মুক্তিযোদ্ধাই আমাদের পথ দেখাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে (ধানমন্ডি ৩২) থেকে ১শ গজ দূর থেকেই আমরা কিছু লোকের ভীড় দেখাতে পাচ্ছিলাম। সেখানে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। কয়েকজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় মানুষ এবং বিদেশি সংবাদকর্মী।
কাছাকাছি পৌঁছাতেই তারা আমাকে সতর্ক করে বললেন, সাবধান শেখ মুজিবের পরিবারকে বন্দী করে রাখা সশস্ত্র পাক সেনারা অনেক বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া একটি গাড়ির দিকে নির্দেশ করে (৩২নং বাড়ির ফটক থেকে সামান্য দূরে প্রধান সড়কে) একজন জানালেন কিছুক্ষণ আগেই তারা একজন সংবাদকর্মীকে গুলি করে মেরেছে। আমি দূর থেকে গাড়ির ভেতর হতভাগ্য সাংবাদিকের গুলিবিদ্ধ লাশটাও দেখতে পাচ্ছিলাম। আরও জানতে পারলাম, মুজিব পরিবারকে (১২ জন) বন্দী করে রাখা দলটি অনেকটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে, সন্দেহজনক কিছু দেখলেও তারা গুলি ছুঁড়ছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত পদক্ষেপ নেয়াটা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিলো। ভেবে দেখলাম আমি যদি আরও সেনা রিইনফোর্সমেন্ট আনতে চাই, তাহলে সেখানেও অনেকটা সময় লাগবে। অথচ আমার হাতে সময় খুব কম। সেনা সহায়তা ছাড়া আমি সামরিক উপায়ে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করতে পারবো না। দ্বিতীয় উপায় হলো, ওদের সঙ্গে আলোচনা করে আত্মসমপর্ণে বাধ্য করা। এজন্য আমাকে নিজের সবটুকু সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধি ব্যবহার করতে হতে পারে। আমি সেটা করতেই মনস্থির করলাম।
এরপর জওয়ানদের কাছে নিজের অস্ত্র জমা রেখে আমি নিরস্ত্র অবস্থায় শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছু দূর এভাবে যেতেই আমার সামনে পড়লো গুলিবিদ্ধ গাড়িটি। মৃতদেহটি এবার বেশ কাছে থেকেই দেখতে পেলাম। ওখানে দাঁড়িয়েই হিন্দিতে চিৎকার করলাম, কোয়ি হ্যায়? বাড়ির ভেতর থেকে কেউ জবাব দিলো না। আমি আবারও বললাম, কোয়ি হ্যায়? এবারও নিরুত্তর।
এরপর ধীরে ধীরে বাড়িটির দিকে এগোতে থাকলাম। এভাবে প্রধান ফটকের কাছে আসা মাত্রই ছাদে থাকা পাক সেনাদের গ্রুপ কমান্ডার চেঁচিয়ে সাবধান করলো, যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে যাও। তুমি যদি আর একধাপ এগোও, তাহলে আমরা গুলি করে তোমাকে মেরে ফেলবো। আমি তৎক্ষণাৎ সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ি এবং ওদের উদ্দেশ্যে বলি, আমি ইউনিফর্ম পরেই আছি। দেখতেই পারছ আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা। তোমরা যদি আমাকে গুলি করো, তাহলে তোমাদের সবাইকে এর চাইতেও ভয়াবহ পরিণতি বরণ করতে হবে। কেউ বাঁচতে পারবে না।
আমি তোমাদের এটা জানাতে এসেছি যে, পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে ইতিমধ্যেই আত্মসমর্পণ করেছে। আমার এই কথা ওরা একেবারেই বিশ্বাস করলো না। কারণ ওদের সঙ্গে সেনাসদরের সকল প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ওরা আত্মসমর্পণের কথা জানতেই পারেনি। তাই ওরা আবারও আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে ধমকালো।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন ঠিক সেই মুহূর্তেই ৩২নং বাড়ির ওপর দিয়ে খুব নিচু দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছিলো। আমি সেদিকে পাকসেনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ঐ দেখো, ওটা একটা ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টার। তোমরা কি নয়মাস যুদ্ধকালীন সময়ে কখনও কোনও ভারতীয় কপ্টারকে ঢাকার আকাশে এভাবে অসতর্ক অবস্থায় উড়তে দেখেছো? আমি তোমাদের মাঝে আসছি। দেখো ভালো করে, আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই। আমি এভাবেই পুরো ঢাকা অস্ত্রছাড়া এসেছি। (পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ ছাড়া) এটাকি সম্ভব? এর মানেই হলো তোমরা হেরে গেছ।
কিন্তু এরপরেও, ভেতরে থাকা সেনারা আমার কোনো কথা মানতে নারাজ। ওরা এবার আরও কড়া সুরে হুমকি দিলো, একজন জওয়ান নিজের গুলিভর্তি বন্দুক সরাসরি আমার দিকে উঁচিয়ে ধরলো। বন্দুক ধরা সেনা বলে উঠলো, ফিরে যাও, আমরা তোমার কোনো কথা শুনবো না। এবার সরাসরি গুলি করবো। আমি বুঝলাম পরিস্থিতি এখন খুবই জটিল। এতদূর এগিয়ে এখানে এসে সামান্যতম ঘাবড়ালে তাতে বিপদ আরও বাড়বে। এমনকি গোটা মুজিব পরিবারের জীবন নিয়েই প্রশ্ন দেখা দেবে। আমি যেকোনও মূল্যে এমন বিপর্যয় এড়াতে চাইছিলাম।
আমি ওখানেই প্রধান ফটক ঘেসে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমনকি গেটের ওপাশ থেকে আমি ওদের সঙ্গে কথা বলা অব্যাহত রেখেছিলাম। এভাবেই কথা চলতে থাকলো আরও ১৫-২০ মিনিট। এর মাঝে ওরা আমার সাহস ভালোই পরখ করে দেখেছে। একজন তো আমি যখন কথা বলছিলাম তখন তার রাইফেলে লাগানো খোলা বেয়নেট আমার পাঁজরের একপাশে আলতো করে লাগাচ্ছিলো। আমি শান্তভাবে ওর অস্ত্রের মুখ ঘুরিয়ে দিলাম। তবে এমনভাবে যাতে সে এটাকে আক্রমণ না ভেবে বসে। এভাবেই সারাক্ষণ সাবধানে থাকছিলাম। আর ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজী করনোর চেষ্টা করছিলাম।
এরই মধ্যে ছাদে থাকা পাক কমান্ডারকে আবারও বললাম, দেখো তোমরা এখনই যদি আত্মসমর্পণ না করো, তাহলে বাংলাদেশের সেনারা আসবে, ভারতীয় বাহিনী আসবে, এমনকি তোমাদের যম মুক্তিবাহিনীও চলে আসতে পারে। এরপর তোমাদের মৃতদেহগুলো নিয়ে ওরা কী করবে, সেটাও তোমরা নিশ্চয় জানো। এই কথার পর ওরা আমার কাছে ওদের সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আরও কিছুক্ষণ সময় চাইলো।
এর মাঝেই বাড়ির ভেতর থেকে মুজিব পরিবারের সদস্যদের চিৎকার ভেসে এলো। ওরা বললেন, দয়া করা এদের আর বাড়তি সময় দেবেন না। এই সেনারা নিষ্ঠুর। আরও সময় পেলে ওরা আমাদের হত্যা করবে। আমিও এমন কিছুই অনুমান করছিলাম। পাক সেনাদের বললাম, এটাই তোমাদের শেষ সুযোগ। আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি। আমার কাছে আত্মসমর্পণ করলে তোমাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। পাকিস্তানে থাকা তোমাদের স্ত্রী-সন্তানদের কথা ভাবো। যদি তাদের আবারও তাদের মুখ দেখতে চাও, তবে অস্ত্র ফেলে দিয়ে এখনই আত্মসমর্পণ কর।
তারা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আমার নির্দেশ মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এরপর তাদের নিয়ে আমি বাড়ি থেকে বের হই। বাইরে এলে অপেক্ষারত জওয়ানরা তাদের গাড়িতে ওঠায়। আর গাড়িটি ভারতীয় সেনাঘাঁটির দিকে রওনা হয়। আর আমি পরিবারের নিরাপত্তায় সেখানেই অবস্থান করছিলাম।
আমি দরজাটা খুলে দিলাম। ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যরা বেড়িয়ে আসতে শুরু করেন। প্রথমেই এলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিনি আমাকে বললেন, তুমি যা করলে তা আমার ছেলের মতো। এরপর আমি পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও কথা বললাম। সেখানে খোকা নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন পাকিস্তানের পতাকাটি নামিয়ে সেখানে বাংলাদেশের পতাকাটি টাঙ্গিয়ে দিতে। আমি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি উড়াতেই নিচে পড়ে থাকা পাকিস্তানি পতাকাটি পদদলিত করে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বললেন, জয় বাংলা। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সবাই জয় বাংলা শ্লোগানে চারপাশ মুখরিত করে তুললো।
পরে কিছুদিন আমাকে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমি ৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তার সঙ্গে দেখা করি। তিনিও আমাকে বলেছিলেন যে, তুমি আমার ছেলের মতো কাজ করেছো। তোমার জন্য আমার বাড়ির দরজা সবসময়ের জন্য খোলা রইলো। তুমি যেকোনও সময় আমার বাড়িতে আসতে পারো। আমরা ২০ জানুয়ারি ভারত ফিরে আসি, ফলে আর কখনই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। সম্পাদনা : রেজাউল আহসান