দোল ও গৌরপূর্ণিমা
প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য : যে-ই গৌর, সে-ই কৃষ্ণ, সে-ই জগন্নাথ। দ্বাপরে যিনি শ্রীকৃষ্ণ, কলিতে তিনিই গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু।
শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ৮৯১ বঙ্গাব্দের ২৩ ফাল্গুন (১৪৮৬ খ্রি.) দোলপূর্ণিমা তিথিতে কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এর আগে পরমভগকান শ্রীকৃষ্ণ নানারূপ নিয়ে সত্যযুগে হোলিকা বধ ও দ্বাপরযুগে দোল পূর্ণিমা লীলা বিলাস করে দিনটিকে মহিমান্বিত করেছেন। স্কন্ধপুরাণে আছে- ‘অন্তঃকৃষ্ণো বর্হিগৌরঃ সাঙ্গোপাঙ্গাস্ত্র পার্ষদঃ। শচী গর্ভে সমাপ্লুয়াৎ মায়া মানুষ কর্মকৃৎ॥’ অর্থাৎ ভগবান অন্তরে কৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার অঙ্গকান্তি দ্বারা বাহিরে গৌররূপ ধারণপূর্বক অঙ্গ (শ্রীনিত্যানন্দাদি), উপাঙ্গ (শ্রীঅদ্বৈতাদি),অস্ত্র (হরিনাম) ও পার্ষদ (শ্রীবাসাদি) সহ শচীগর্ভে প্রকটিত হইয়া মায়িক মানুষের ন্যায় কর্ম করিবেন।সত্যযুগে ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে দেবতা ব্রহ্মাজী ভক্ত হোলিকার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন যে, ‘নিষ্পাপ থাকলে তাকে আগুন স্পর্শ করবে না’। এদিকে ভগবান এদিকে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু তার ছেলে প্রহ্লাদকে বিষ্ণুভক্ত হওয়ায় বার বার হত্যাচেষ্টা করে। একপর্যায়ে সে ক্ষুব্ধ হয়ে বোন হোলীকাকে প্রহ্লাদসহ আগুনে নিক্ষেপ করে। কিন্তু বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে অন্যায়ভাবে আগুনে দেয়ার কারণে হোলীকার প্রাপ্ত বর বিফল হয়। সে নিজেই আগুনে ভষ্মীভূত হয়। আর শিশু প্রহ্লাদকে ভগবান রক্ষা করেন। অশুভ দানবী হোলীকা নাশ হয় তাই এই আনন্দ উৎসবের নাম হোলী উৎসব।
৫৫০০ বৎসর পূর্বে দ্বাপর যুগে এমনদিনে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারাণীকে একত্রে দর্শন করতে পেরে ব্রজবাসীরা তাদের ফুলের দোলনায় বসিয়ে মহাআনন্দে দোলাতে থাকেন। সেই আনন্দ ক্রমেই বহুগুনে বর্ধিত হলে তাঁরা রাধাকৃষ্ণের চরণে বিভিন্ন বর্ণের আবির ঢেলে প্রেমানন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটান। আর সেইলীলাকে স্মরণ করে আজও আনন্দ উৎসব দোলপূর্ণিমা পালিত হচ্ছে। বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ লীলাবিলাস করে জগতের অন্যান্য, জীবদের কথা ভাবলেন- ‘চিরদিন নাহি করি প্রেম ভক্তি দান/ ভক্তিবিনা জগতে নাহি অবস্থান।’ (চৈ.চ.)।
প্রেমভক্তির দ্বারা গোলক বৃন্দাবনে যাওয়া যায় কিন্তু ভগবানতো সহজে প্রেমভক্তি দান করেন না। তাই আজকের পূণ্য তিথিতে অধঃপতিত জীবদের উদ্ধার করতে পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং কৃপা করে ভক্তবেশ ধারণ করে শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু রূপে আবির্ভূত হলেন।
বরাহপুরাণে : ‘কলেঃ প্রথমসন্ধ্যায়াং লক্ষ্মীকান্তো ভবিষ্যতি। ব্রহ্মরূপং সমাশ্রিত্য সম্ভবামি যুগে যুগে॥’ অর্থাৎ কলির প্রথম সন্ধ্যায় লক্ষ্মীকান্ত ব্রাহ্মণরূপ আশ্রয় করিয়া আবির্ভূত হইবেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে আছে- ‘কৃষ্ণবর্ণংত্বিষাকৃষ্ণং সাঙ্গো পাঙ্গাস্ত্র পার্ষদম্। যেজ্ঞৈঃ সংকীর্তন প্রায়ৈ র্র্যজন্তি হিসুমেধসঃ।।(ভা.১১/৫/৩২)
অর্থাৎ যে পরমেশ্বর ভগবান ‘কৃষ’ ও ‘ণ’ শব্দাংশ দুটি নিরন্তর উচ্চারণ করেন, কলিযুগে বুদ্ধিমান মানুষেরা তাঁর উপাসনার নিমিত্ত সমবেতভাবে নাম-সংকীর্তন করে থাকেন। যদিও তাঁর গাত্রবর্ণ অ-কৃষ্ণ, তবুও তিনি স্বয়ংকৃষ্ণ। তিনি সর্বদা তাঁর পার্ষদ, সেবক, সংকীর্তন রূপ অস্ত্র ও ঘনিষ্ট সহচর পরিবৃত থাকেন। ব্রহ্মসংহিতায় আছে- ‘গোবিন্দং আদি পুরুষং।’ অর্থাৎ বিশ্ব ব্রহ্মা-ের সবচেয়ে আদি পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর পূর্বে কোন কিছুই ছিল না।
সৌর পুরাণ : ‘সুপূজিতঃ সদা গৌরঃ কৃষ্ণো বা বেদবিদ্ দ্বিজঃ।’ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই বৈদিক ব্রাহ্মণ হইয়া বা শ্রী গৌরাঙ্গরূপে জগতে পূজিত হইবেন।
তাই আজকের দিনে সকলের কর্তব্য হচ্ছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপাসিক্ত হয়ে হরিনাম সাগরে অবগাহনের মাধ্যরম নিজেদের বিশুদ্ধ করে তোলা।
লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউটস্ অব হায়ার এডুকেশন, ইসকন, ঢাকা।