একান্ত সাক্ষাৎকারে বিএসইসির চেয়ারম্যান পুঁজিবাজার দুষ্কৃতিকারীদের আখড়ায় পরিণত হতে যাচ্ছিল
মো. আখতারুজ্জামান : দীর্ঘদিন থেকে মন্দায় থাকা দেশের পুঁজিবাজার করোনা মহামারীতে চরম সংকটের মুখে পড়ে। বাজারের অস্থিরতা ঠেকাতে লেনদেন বন্ধ থাকে ৬৬ দিন। পরে সীমিত আকারে জুনে লেনদেন শুরু হয়। এই সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন নেমে আসে ৫০ কোটি টাকার নিচে। করোনার সংকটে যেখানে ডিএসই সূচক ৪ হাজার পয়েন্টে নেমে এসেছিল। তবে গত দুই মাসে সে সূচক বেড়েছে ৯১৮ পয়েন্ট। শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে এ সময় ডিএসইর মোট বাজার মূলধন বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। আগস্ট মাসে বিশ্বের সেরা পারফরমেন্স করে ডিএসই। এতো কম সময়ে কিভাবে দেশের পুঁজিবাজার এতো ভালো করলো এসব বিষয়ে নিয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের।
তিনি বলেন, বর্তমানে বিএসইসিতে যে ৫ জন রয়েছি তার মধ্যে তিনজনই শিক্ষকতা করে এসেছি। সেই সঙ্গে আমরা পুঁজিবাজার রেলেটেড বিষয় নিয়েই লেখাপড়া করেছি। এই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি। শিক্ষার্থীদের মাঝে পুঁজিবাজারের যে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। সেই সব এখন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি।
শিবলী রুবাইয়াত বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর যেসব জায়গায় গভর্নেন্স ব্যবস্থাপনায় যে সমস্যাগুলো ছিলো সেটা দূর করার ব্যবস্থা করেছি। এটা করতে গিয়ে দেখেছি কিছু কিছু জায়গায় কিছু দুষ্কৃতি লোক কাজ করত। তারা বিভিন্নভাবে নিরিহ বিনিয়োগকারিদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের অর্থ নিয়ে নিত। আমরা এসব জায়গাকে চিহ্নিত করে ডিসিপ্লিন আনার চেষ্টা করেছি। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখিছি অল্প কয়েজন লোকের কারণে পুঁজিবাজার দুষ্কৃতিকারীদের আখড়ায় পরিণত হতে যাচ্ছিল। এসব কাজ করতে গিয়ে আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি।
বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন রকম মিউচ্যুয়াল বন্ডের অনুমোদন দিয়েছি। ৮.৫০ কোটি টাকার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের জিরো কোপন বন্ডের অনুমোদন দিয়েছি। প্রাণ গ্রুপকে আমরা ২৫ মিলিয়ন টাকার বন্ডের অনুমোদন দিয়েছি। বিভিন্ন ধরনের বন্ড নিয়ে এসে আমরা পুঁজিবাজারকে আরও বেশি ভাইব্রেন্ড এন্ড ডায়নামিক করার চেষ্টা করছি। ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর যে চাপ ছিলো সেটা কমিয়ে আনার জন্য তাদেরকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। পুঁজিবাজারের দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা সেইটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। শিবলী রুবাইয়াত বলেন, আমরা মনে করি এসব কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারিদের আস্থা ফিরে এসেছে। এর ফলে তাদের সঞ্চয় বাজারে বিনিয়োগ করছে। এই মহুর্তে পুঁজিবাজার হচ্ছে বিনিয়োগ করার ভালো জায়গা। এখন বিনিয়োগকারিরা ভালো রিটার্ন পাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই সময়ে সবাই মিলি যে চেষ্টা করেছি তার কিছুটা ফল ব্লুমবাগের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। তারা বলেছে, আগস্ট মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্রোড ইনডেক্স বেড়েছে ১৫.৮০ শতাংশ। যা বিশ্বের সেরা পারফরমেন্স বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা হয়েছে সবার সম্মিলত চেষ্টার কারণে। সেই সঙ্গে আমাদেরকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন ও ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, নতুন দুর্বল কোম্পানিগুলোর বিষয়ে যেমন ব্যবস্থা নিয়েছি তেমন বাজারকে আরও গতিশীল করার জন্য ভালোমানের কোম্পানি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছি। আমরা যে কোম্পানিগুলোকে বাজারে নিয়ে এসেছি তারা ২০ থেকে ৪০ বছর ধরে ব্যবসায় ভালো করে আসছে। এসব নির্ভর যোগ্য কোম্পানির কাছে বিনিয়োগকারিদের অর্থ পৌঁছাই দিতে চাই। আমরা আশা করছি এসব কোম্পানি বিনিয়োগকারিদের ভালো রিটার্ন দিয়ে তাদের কোম্পানির মুখ উজ্জ্বল করবে। তিনি বলেন, গত তিন মাসে বাজার অস্থিতিশীলকারি দুর্বল ও অস্তিত্বহীন কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম কারসাজি করে বাড়ানো হয়। সেই সঙ্গে বিনিয়োগকারিরা নাম বুঝে এ সব কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে থাকে। পরেই দেখা যায় একটা পর্যায় গিয়ে দাম কমে যায়। পাশাপাশি ভালোমানের বেশি কিছু কোম্পানিকে বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা যাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছি তাদের কাছেই সঠিকভাবে সহযোগিতা পেয়েছি। শিবলী রুবাইয়াত বলেন, পুঁজিবাজারে নানা ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে। অপ্রদর্শিত অর্থ সেখানে একটি উপাদান। যখন বাজারটি খারাপ ছিলো তখন আমরা চার দিকে ড্রাইভ দিয়েছি। কিভাবে দ্রুত বাজারকে চাঙ্গা করা যায় সেই চিন্তা থেকে। সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি অফিসে অফিসে গিয়েছি। আর সেই কারণে আমাদের চতুর্মুখী প্রচেষ্টার কারণে আজকে বাজারটা ভালো অবস্থানে চলে গেছে। আশা করি একদিকে কালো টাকা সাদা হবে অন্যদিকে এখান থেকে সরকারও কিছু অর্থ পাবে। আমরা মনে করি বিদেশে পাচারের চেয়ে কালো টাকার বিনিয়োগ দেশের স্বার্থে অনেক ভালো। তিনি আরও বলেন, অনেকে বড় অংকের টাকা নিয়ে এসে ম্যানুপুলেট (কারসাজি) করার চেষ্টা করা হয়। তবে আমরা সেই দিকটায় বেশি নজর দিয়েছি। আমরা এখন অনেকে কিছু দেখতে পারি বুঝতে পারি। যার ফলে আমরা প্রত্যেকটি কমিশন সভায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ সবের মাধ্যমে বাজারে একটি ম্যাসেজ চলে গেছে যে, কারসাজি করা সম্ভাব নয়। আর যদি কেউ করেও সে ধরা পরলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা। আশা করি সামনের দিনগুলোতে পুঁজিবাজারে সুস্থ পরিবেশ দেখতে পারবো।