ঢাকা ও আশপাশের এলাকার ৭০ ভাগ গ্যাস বিদ্যুৎ লাইনই ঝুঁকিপূর্ণ, জবাবদিহিতা নেই, বাড়ছে দুর্ঘটনা
শাহীন চৌধুরী: নারায়ণগঞ্জে মারাত্মক গ্যাস দুর্ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ। এখন খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে। তথ্য যা আসছে তা খুবই ভয়াবহ। গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন যেন মৃত্যুফাঁদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৬০ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু হয়। ঢাকায় বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ শুরু ১৯৬৭ সালের দিকে। এরপর বিতরণ লাইন বাড়তে থাকে। প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার গ্যাস পাইপ লাইন আছে এখন। এর মধ্যে বিতরণ ও সার্ভিস লাইন প্রায় ২০ হাজার কিলোমিটার।
তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন এন্ড ট্রান্সমিশন কোম্পানির পাইপলাইন আছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকায় সাত হাজার কিলোমিটার। যার ৭০ শতাংশ অতিঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ৫০ বছরেরও পুরোনো বিতরণ লাইন আছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনার ফিরিস্তি অনেক।
গ্যাসের মত বিদ্যুতেরও একই অবস্থা। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে তার ছিঁড়ে মৃত্যু। বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তার ছিঁড়ে মৃত্যু। বাড়ির ছাদে কাপড় শুকাতে গিয়ে মৃত্যু। ছাদে ঘুড়ি নামাতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু। ঘরে পানি উঠেছে, সেখানেও তার ছিঁড়ে মৃত্যু। বিদ্যুতের তারে এমন মৃত্যু অহরহ ঘটছে। কিন্তু কোন জবাবদিহি নেই। গ্রাম শহর কোথাও এই মৃত্যু থেমে নেই।
এক তথ্যে জানা যায়, ২০১৭ সালের পোড়া রোগীর ২৮ শতাংশই বাড়ির আশেপাশে টানানো তারে স্পৃষ্ট হয়ে দগ্ধ ও আহত এবং ১৯ শতাংশই বৈদ্যুতিক খুঁটির তার ছিঁড়ে দুর্ঘটনায় পড়েন। ২০১৬ সালে দগ্ধ রোগীদের মধ্যে যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। কিন্তু এরপরও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ লাইন মেরামত হচ্ছে না। দীর্ঘ দিনের পুরানো, জরাজীর্ণ, অপরিকল্পিত, অবৈধ, অনিরাপদ পাইপ বা তারে ভরা। প্রতিনিয়ত এসব থেকে দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু প্রতিকার নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জবাবদিহির অভাবেই অগ্নিকা- ও প্রাণঘাতী ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। এক পরিসংখ্যানে ফায়ার সার্ভিস জানায়, রাজধানীতে অগ্নিদুর্ঘটনার প্রায় ৩০ ভাগই গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে। গত এক বছরে ছোট-বড় প্রায় এক হাজার অগ্নিকা-ের জন্য দায়ী গ্যাস। কোন দুর্ঘটনা ঘটলে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিকার হয় না। পুরানো লাইন মেরামত করা হয় না। দীর্ঘদিন মাটির নীচে থাকা গ্যাস পাইপ স্থানে স্থানে ছিদ্র হয়ে আছে। রাজধানীর বহু এলাকায় রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই এমন গ্যাস বের হওয়ার ঘটনা দেখা যাবে। টের পাওয়া যাবে রাস্তায় যত্রতত্র গ্যাস উবে যাওয়ার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, টঙ্গীসহ বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ইচ্ছেমত গ্যাস উবে যাওয়ার ঘটনা বেশি। গ্যাস বিতরণ কোম্পানিরই স্থাপন করা পাইপ দিয়ে এসব গ্যাস বের হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাইপ থেকে গ্যাস বেরিয়ে যদি বদ্ধ জায়গায় জমা হতে থাকে আর তার পরিমাণ বাতাসে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হয়, তাহলে আগুন ধরার পরিবর্তে বিকট শব্দে বিম্ফোরণ ঘটে। এর পরিমাণ ২০ শতাংশ পেরোলে অগ্নিকা- ঘটে। আগে পাইপের গ্যাসে এক ধরনের গন্ধযুক্ত রাসায়নিক মেশানো হত। যাতে কোথাও লিকেজ হলে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। সহজে বোঝা যায় গ্যাস বের হচ্ছে। কিন্তু এখন এই কার্যক্রম বন্ধ।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ঢাকায় ৩৫/৪০ বছরের গ্যাস পাইপলাইন আছে। এগুলো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজধানীতে দুই হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন প্রতিস্থাপন করা হবে। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে পুরোনো পাইপ সরিয়ে নতুন করে স্থাপনে বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
ক্যাব-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, নিরাপত্তা মানদ- না মেনে বিদ্যুৎ বা গ্যাস লাইন সম্প্রসারণ ও সংযোগ দেয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। বিদ্যুৎ লাইনের সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে বিতরণকারী সংস্থাগুলোর ভুল এবং অবহেলার কারণে দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার হচ্ছে জনগণ। সম্পাদনা: সালেহ্ বিপ্লব