রিমান্ডে নির্যাতন ১৭ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা
এস এম নূর মোহাম্মদ : কোনো আসামি বা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। এমনকি রিমান্ডে নির্যাতনের ফলে অনেক সময় আটক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
সম্প্রতি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদিপ কুমার দাসের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তিনি রিমান্ডে নিয়ে তাকে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জে ধর্ষণের পর খুন হওয়া স্কুল ছাত্রী জীবীত ফেরত আসার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ওই ঘটনায় স্বীকারোত্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া তিন আসামির পরিবার বলছে, তাঁদের ওপর নির্যাতন করে জবানবন্দি আদায় করা হয়। কেবল এই দুটিই নয়, রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগ প্রায় সব আসামির।
সংবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ আদালতের রায় বা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তবে দীর্ঘ সময়েও রায় বাস্তবায়ন না হওয়াকে আদালত অবমাননা বলছেন আইজ্ঞরা। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরাট অংশ বিচারবর্হিভুত হত্যাকা-, গুম, মাদক ব্যবসা, ক্রসফায়ারের নামে চাঁদাবাজীÑইত্যাদির ঊর্ধ্বে চলে গেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনাগুলো তাদের জন্য এখন প্রযোজ্য বলে তারা মনে করে না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ফৌজদারি মামলার বিচারকরাও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার ব্যাপারে খুব বেশি যতœবান বলে মনে হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী মনজিল মোরসেদ বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে মৌলিক কোন বিষয়ে আদালত থেকে আসলে সেগুলো কার্যকর না করে পাশ কাটানো হয়। যেমনটা হয়েছে মাসদার হোসেন মামলার ক্ষেত্রে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নীতি-নির্ধারণী যেসব নিয়ম-কানুন আছে সেগুলোর বিষয়ে যারা এখন প্রশাসনে বা ক্ষমতায় আছেন তারা আগ্রহী না। কারণ আইনের শাসন অনুযায়ী চলতে গেলে যা খুশি তাই করা যায় না।
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, এখন যারা প্রশাসন চালায় তারা জবাবদিহিতা চায় না। এটা হলে শাহেদ-সাবরিনা সৃষ্টি হবে না। রিমান্ড সংক্রান্ত নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে কর্মপদ্ধতিটাই পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর এটা হলে তাদের অনেক সমস্যা। সে জন্যই তারা এটা করবে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। সেটা করা হয় ঠিকই, কিন্তু এর আগে ৪৮ ঘণ্টা,৭২ ঘণ্টা, ১০০ ঘণ্টা কাস্টডিতে থাকে। মানে গ্রেফতার করে স্বীকারই করা হয় না। এর জন্য রাষ্ট্রের চরিত্র বদলাতে হবে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। শুনানিতে হাইকোর্টও স্বীকারোত্তিমূলক জবানবন্দী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গ্রেপ্তার ও রিমান্ড বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে শিশির মনির বলেন, সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী রেকর্ড করা। যদি কেউ এই নির্দেশনাসমূহ না মানেন তাহলে অবশ্যই আদালতের আদেশের অবমাননা হবে।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল সন্দেহভাজন কোনো আসামি বা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৬ সালে আপিল বিভাও তা বহাল রাখেন। রায়ে বলা হয়েছে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কোনো প্রকার নির্যাতন করা যাবে না। রিমান্ড প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের অভ্যন্তরে কাচ নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। যাতে নির্যাতন করা হচ্ছে কিনা দেখা যায়।
এতে আরও বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে চিকিৎসককে দিয়ে আসামির শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে। চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠাতে হবে। হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল বোর্ড গঠন করবেন। বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। পুলিশ হেফাজতে বা কারাগারে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি মারা গেলে তাৎক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। আর মৃতের আত্মীয়ের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তা তদন্তের নির্দেশ দেবেন আদালত। বিচারকদের প্রতি নির্দেশনায় বলা হয়, কেইস ডায়েরি ছাড়া কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক ওই ব্যক্তিকে মুক্তি দিবেন।
এদিকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধন বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রিভিউ আবেদনের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বলেন, ২০০৩ সালে রায় দেওয়া হয়েছে। বাস্তবায়ন করা না হলে রায় দিয়ে লাভ কী। আদালত অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনাদের রিভিউ আবেদন স্পষ্ট নয়। রায়ে যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেগুলোর কোথায় কোথায় আপত্তি সেটা সুনির্দিষ্ট করে বলুন। এই রায় পুরোটা রিভিউ হবে না। বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিষয়টি যে কারো ক্ষেত্রে হতে পারে, এমনকি আমাদের আত্মীয় স্বজনদের ক্ষেত্রেও। যদি কেউ নিখোঁজ হয়ে যায়Ñতার দায় দায়িত্ব কে নেবে।