
পরশ্রীকাতরতার বেড়াজাল পেরিয়ে পদ্মা সেতু পেয়েছে আপন অবয়ব

অধ্যাপক ড. এম এ মাননান
পরশ্রীকাতরদের মুখে চুনকালি দিয়ে তৈরির কাজ সমাপ্ত হলো দেশের বৃহত্তম আর পৃথিবীর ১৩তম দীর্ঘ পদ্মা সেতু। এখন বাকি শুধু ‘কসমেটিকের’ কাজ। বছর খানেক পরেই চলবে যানবাহন; উড়বে বাংলার মানুষের আত্মনির্ভরশীলতার উড়াল পাখি, যার স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্বনন্দিত বঙ্গকন্যা- দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া জাতিকে স্বপ্নদেখানোর জাদুকর। এখন আর হিংসুকেরা ছুড়ে দিতে পারবে না ‘এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। আমরা একটি নয়, দুটি সেতু তৈরি করে দেবো…’ ইত্যাদি বিদ্বেষমূলক বাক্যবাণ। হিংসুক আর পরশ্রীকাতর মুষ্টিমেয় মানুষগুলোর মুখ হয়ে গেছে মুক, দেশপ্রেমীদের বদনে তরুণ অরুণের মিষ্টি ঝলক। বাংলার মানুষ এখন অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। মানুষ এখন ভাবছে সোৎসাহে ‘ইচ্ছে দৃঢ় হলে আমরাও পারি’, পারি জয় করতে ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’। আমাদের সাথে আছেন চৌকষ ধীরস্থির প্রচ- আত্মবিশ্বাসী একজন অটল চিত্তের পথপ্রদর্শক, চলার সঙ্গী, ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার কান্ডারি। ভয় কীসের? ভয়কে তো জয় করেই ফেলেছি। পদ্মা সেতু স্বপ্নের চারদেয়াল ভেদ করে এখন বাস্তবের পরশে দেদীপ্যমান। পদ্মা সেতু আমাদের বিশ^াসের ভিত করে দিয়েছে মজবুত; সামনে এগিয়ে চলার সাহসকে করেছে অমিত শক্তির মেরুজ্যোতিতে দীপ্তিমান।
পদ্মা এখন আর শুধু একটি খরস্রোতা নদীর নাম নয়। পদ্মাসেতু সে নদীর বুক দাবড়িয়ে মাথাতোলা একটি অহঙ্কারের নাম, গর্বের নাম, আত্মতৃপ্তির নাম। তার মর্মস্থলে খচিত আছে একজন বিজয়ীর নাম। বাংলার মানুষের হৃদয়-ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করেবে এ নামটি অনন্তকাল ধরে। বিজয়িনী থাকবেন না একদিন; চলে যাবেন পর্দার আড়ালে প্রকৃতির অমোঘ বিধানের কারণে। তবে তার হাসিমাখা লৌহমানবীর আদলে গড়া মায়াবী চেহারা পিতার নামের সাথে যুক্ত হয়ে স্বর্ণাভ করে তুলবে আগামীর ইতিহাসকে।
যে পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে বিশ^দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে, সে সেতুটি এমনি এমনি তৈরি হয়ে যায়নি। দেশের ভেতরে বিরোধীরা যেমন কঠোর নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল, তেমনি দেশের বাইরে থেকেও সোচ্চার ছিল আন্তর্জাতিক একটি কুচক্রী মহল। নিজের পায়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশ? এখনও চায় না অনেকে। আর জাতির পিতার সময়ে শুরু হওয়া যে অধরা স্বপ্ন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে তারই কন্যার হাত ধরে, তাতো সহ্যই করতে পারেনি ওই চক্রটি। ফলাফল, ঘোর বিরোধিতা, সাহায্য প্রত্যাহার, মন্ত্রী-কর্মকর্তাদের চরিত্র হনন আর অবিশ^াস্য অভিযোগ এবং আরও কতো কী অশ্রুতপূর্ব কর্মকা-। স্বার্থ, লোভ আর পরশ্রীকাতরতা নাজুক করে দিতে চেয়েছিল বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার অদম্য হাতকে।
এদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসুক, চায়নি ওরা। অর্থনীতি উজ্জীবিত হোক, যুগ যুগ ধরে নিষ্পেষিত বাংলার মনুষ ঘুরে দাঁড়াক, উদীয়মান ব্যাঘ্র হয়ে গর্জে উঠুক, এসব চিন্তা করাতেও ছিল ওদের আতঙ্ক। কিন্তু ওরা হয়তো জানে না, স্বপ্নবাজরা কখনো কোনো কিছুকে ভয় পেয়ে নিজের ভেতরে সেঁটে যায় না। এগুতে থাকে সুনামির বেগে। পদ্মা সেতু প্রমত্ত সুনামির বিপরীতে প্রচ- ধাক্কা দেওয়া এক দুঃসাহসী নাম এখন পৃথিবীর ইতিহাসে। বিশ^বাসী দেখছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের হররোজ শিকার বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র ভুখন্ডটি কীভাবে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল ব্যয়ের অভাবনীয় কা-টি ঘটিয়েছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষের অহঙ্কার হয়ে থাকবে চিরকাল। হয়তো অনেকেই ভাববে, বাংলাদেশের মতো স্বপ্নবাজ আর দুঃসাহসী মানুষের দেশে জন্মগ্রহণ করাটাই হবে গর্বের বিষয়। লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উš§ুুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
