দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানতে বাজারে সরবরাহ ও উৎপাদন বাড়াতে হবে
ড. আহমদ আল কবির
অর্থনীতির জন্য বাজার স্থিতিশীল রাখা খুবই প্রয়োজন। এখন শীতকালীন শাক-সবজির মৌসুম হওয়ায় এর দাম কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে, কিন্তু চালসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দামের ওঠানামা অনেক। অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ার প্রবণতা আছে। ব্যবসায়ীদের মধ্যেও একটা প্রবণতা অত্যন্ত প্রকটভাবে লক্ষ্যণীয়- যখনই তারা দ্রবসামগ্রীর দাম বাড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে, তখনই বাড়াচ্ছে। দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। সরবরাহ বৃদ্ধি করলে বাজার স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থিতিশীল হয়ে যাবে। যখনই সরকার ন্যায্যমূল্যে চাল বিতরণ শুরু করে তখনই এর বাজারে লাগাম টানা সম্ভব হয়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা দেখেছি। আবার পেঁয়াজের দাম যখন কমে তখন বিদেশ থেকে আমদানি করলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের কৃষকরা অনেক সময় ন্যায্য দাম পায় না বলে অভিযোগ করা হয়। এ জাতীয় একটা শাখের করাতও আছে। যে খাতগুলোতে আমাদের সংকট, আগামী বছর যেন এ সংকটটা না হয়, তার জন্য সেখানে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। এ খাতগুলোকে সহায়তা করতে হবে যেন উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হবে।
আর স্বল্পমেয়াদী সমাধান হচ্ছে বাজার ব্যবস্থাপনায় মনিটরিং বাড়ানো। গত ২-৩ মাস ধরে লক্ষ্য করছি, বাজার মনিটরিং অনেক কমে গেছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় বাজার মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। মনিটরিংয়ে শুধু শাস্তি দিলেই হবে না। মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের চেইনটাকে ভাঙতে হবে। এ চেইন ভাঙার জন্য বড় বড় মজুদদার যারা তাদের ওপরেই বেশি নজর দিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা যেন দাম না বাড়াতে পারে সেটার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীরা অনেক বেশি দাম বাড়াতে পারে। কারওয়ান বাজারে পাইকারী বাজার থেকে ১০০ গজ দূরে খুচরা মার্কেট। এখানে দামের মধ্যে পার্থক্য প্রায় অর্ধেক। এমনটা হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সরববারহ দুইভাবে বাড়ানো যায়- উৎপাদন বৃদ্ধি করে ও আমদানি বৃদ্ধি করে। রমজানের আর মাত্র দুই মাস বাকি রয়েছে। এখন থেকেই রমজানের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। কী পরিমাণ মজুদ রয়েছে, এর পরিসংখ্যান দেখে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিদেশে থেকে আমদানি করলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। প্রয়োজনে আমদানি খাতে প্রণোদনা দিতে হবে। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে না পারলে কঠোর আইন প্রয়োগ করে এর সমাধান করা যাবে না। এটা একটা সাময়িক সমাধান। অতএব এ সাময়িক সমাধানের দিকে না গিয়ে আমাদেরকে চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। এটা খুব জরুরি এবং এখনই সর্বোত্তম সময়। এখনই যদি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয় তাহলে রমজানের শুরুতে সরবরাহ বাড়বে। এর জন্য সরকারকে বিশেষ পণ্যের জন্য কর ছার দিতে হলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং ব্যবসায়ীদের এ সুযোগটা দিতে হবে। এতে করে সরবরাহ বাড়বে এবং দাম কমবে। ভর্তুকি দিয়ে আমদানিকে উৎসাহ দেওয়া হলে এবং সরকারি উদ্যোগেও আমদানি করা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। সার্বিকভাবে যেসব নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে তাতে বড় ধরনের কোনো উলম্ফণ না থাকলেও কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এটা পরিষ্কার। এখানে কৃত্রিম সংকটও অনেক সময় তৈরি করা হয়।
একসময় আমাদের মৎস্য খাতে সংকট ছিলো। এখন উৎপাদন বাড়িয়েই আমরা একটা স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করেছি। অনুরূপভাবে মাংসের উৎপাদন যদি আমরা বাড়াতে পারি, তাহলে এখাতও স্থিতিশীল হবে। মাংসের বাজার দেশে বিদেশে উন্মুক্ত করে দিলে, প্রয্ুিক্ত নির্ভর মিট প্রসেসিং প্লান্ট সরকারি সহায়তায় করা সম্ভব হলে বাজারের ওপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রভাব পড়া শুরু করবে। সকল ক্ষেত্রেই স্বয়ম্ভর হওয়ার জন্য আমাদের নিজস্ব উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। নতুন নতুন উৎপাদক ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে।
লেখক পরিচিতি : রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান। সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখাটি লিখেছেন আমিরুল ইসলাম। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও