আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
আসছে ই-কমার্স নীতিমালা গুরুত্ব পাচ্ছে সেবাগ্রহীতার অধিকার
মো. আখতারুজ্জামান : নতুন সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে দেশের ই-কমার্স। দিন যত যাচ্ছে বিনিয়োগের পাশাপাশি বাড়ছে এর পরিধিও। নীতিমালা না থাকায় অনলাইন ভিত্তিক এ ব্যবসায় খাতে বাড়ছে গ্রাহক হয়রানি ও প্রতারণাও। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সরকার নীতিমালা করতে যাচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ করতে যাচ্ছে।
জানা যায়, বর্তমানে ই-কমার্স চলছে জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০২০-এর আওতায়। তবে নীতিমালায় এ ব্যবসা কিভাবে পরিচালিত হবে তার কোনো কিছু বলা নেই। আর এটাকে ব্যবহার করে উদ্যোক্তারা যে যার মত করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। ফলে ই-কমার্সের পরিধি যত বাড়ছে অনিয়মও তত বাড়ছে। সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগের পরিমাণও বাড়ছে।
অনেক ডিজিটাল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপ স্বচ্ছ নয় বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহিও হয় না। সে জন্য এ সেবার অসুবিধার দিকগুলো বিবেচনায় নিয়ে ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে আগামী মার্চের মধ্যে নীতিমালা চূড়ান্ত হবে। যদিও নীতিমালার বেশকিছু শর্তে দ্বিমত পোষণ করেছেন ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এমন নীতিমালা করা যাবে না, যাতে দেশের উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর বিদেশি উদ্যোক্তারা সুবিধা নেয়।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, পণ্য মজুদ রাখার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব গুদাম ঘর থাকতে হবে। গুদামে প্রত্যেকটা পণ্য কি পরিমাণ মজুদ রয়েছে সেটা ওয়েবসাইটে বর্ণনা থাকতে হবে। আর সে আলোকে ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয় আদেশ নিতে হবে। আর এটা করা হয়েছে এ জন্য যে, যাতে করে গ্রাহকরা পণ্য পেতে কোনোভাবেই কালক্ষেপণের মধ্যে না পরে। কোনো তৃতীয় পক্ষের পণ্য হলে সেক্ষেত্রে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম ওয়েবসাইটে উল্লেখ রাখতে হবে। অর্থাৎ পণ্যের বিষয়ে গ্রাহকদেরকে ভালো ধারণা দিতে হবে। আপনার পণ্য নেই অথচ আপনি ব্যবসা খুলে বসে আছে এটা আর হবে না।
বর্তমানে যে যার মত করে ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট তৈরি করছে বা করে থাকে। ই-কমার্সের নীতিমালায় এখন থেকে কেউ চাইলেই এটা করতে পারবে না। বলা হয়েছে, এমন ওয়ালেট তৈরি করতে হলে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিপত্র লাগবে। অন্যথায়, কেউ চাইলেই ভার্চ্যুয়াল ওয়ালেট তৈরি করতে পারবে না।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য ক্রয়ের ক্ষেতে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে গ্রাহকদের কিছু তথ্য নিয়ে থাকে। এসব তথ্য কিভাবে কোথায় সংরক্ষণ রাখা হয় তা ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকতে হবে। বর্তমানে এ তথ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারাণা রয়েছে। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে নীতিমালায় গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণের বিষয়ে বলা হয়েছে।
পণ্য ক্রয়ের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে মোবাইলে এসএমএস-এর মাধ্যমে জানাতে হবে। ক্রেতার কাছ থেকে পণ্য দেয়ার আগেই অর্থ নেওয়া হলে সেক্ষেত্রে নীতিমালায় দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। ক্রেতা এবং বিক্রেতা যদি একই শহরে বা এলাকার হয় তাহলে অগ্রিম অর্থ নেওয়ার ৫ দিনের মধ্যে পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হবে। আর ক্রেতা এবং বিক্রেতা যদি ভিন্ন ভিন্ন শহর বা এলাকার হয় সেক্ষেত্রে ১০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হবে। অনেক সময় পণ্যের ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি বা পণ্য বিক্রির পর যে সার্ভিসের কথা বলা থাকলে তার সংশ্লিষ্ট কার্ড বা কাগজপত্র পণ্যের সঙ্গে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কত দিন বা সময় ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি বা সার্ভিসের বিষয়ে কার্ড বা কাগজপত্রে উল্লেখ রাখতে হবে। একটি পণ্যে ক্রয় করতে হলে অন্য আর একটি পণ্যে ক্রয় বাধ্যতামূলক। এ নিয়ম কেউ করতে পারবে না। এটা করলে নীতিমালার পরিপন্থী কাজ বলে বিবেচিত হবে।
ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া হলে ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে অগ্রিম নেওয়ার ৫ দিন এবং ভিন্ন শহরের হলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে হবে। যেসব পণ্যের ওয়ারেন্টি বা গ্যারান্টি রয়েছে, সরবরাহের সময় সেগুলোর কার্ড ক্রেতাকে দিতে হবে। সেই কার্ডে উল্লেখ থাকতে হবে কত দিন এবং কোথা থেকে এ সেবা পাওয়া যাবে।
বর্তমানে অধিকাংশ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকদের সেবা দিতে মাত্র একজন কাস্টমার কেয়ার কর্মী নিয়োজিত। এর ফলে অনেকে গ্রাহক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাস্টমার কেয়ার থেকে সঠিকভাবে সার্ভিস পান না। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংখ্যার আনুপাতিক হারে কাস্টমার কেয়ারে কর্মী নিয়োজিত রাখতে হবে। যাতে গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজনে খুব সহজেই সার্ভিস পান।
পণ্যের মূল্যসহ কর, ভ্যাট ও সার্ভিস চার্জের বিষয়ে বিস্তারিত পরিস্কারভাবে ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রত্যেকটা পণ্যের উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পণ্যে মোড়কে বা সংশ্লিষ্ট কাগজে থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতে নকল বা ভেজাল বা অনুমোনহীন পণ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা যাবে না।
ট্রেড লাইসেন্স বা নিবন্ধন ছাড়া কেউ ই-কমার্স করতে পারবে না। অন্যদিকে, থাকতে হবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য পদ। আর নিবন্ধন ও সদস্য নম্বর নিজেদের ওয়েবসাইটে রাখতে হবে।
প্রিয়শপ ডটকমের ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও আশিকুল আলম খান জানান, আমাদের কোনো নীতিমালা নেই। স্ট্যার্ন্ডাড নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। তবে সেটা যেন উদ্যোক্তাদের জন্য সমস্যা না হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এখানে অনেক উদ্যোক্তা রয়েছে, যাদের নিজস্ব কোনো পণ্য নেই। সেইসঙ্গে তারা খুব ছোট পরিসরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। তারা এ নীতিমালা কিভাবে পরিপালন করবে। তাদের তো সে সক্ষমতা নেই। তাই সরকারের উচিৎ হবে এমন নীতিমালা করা, যাতে সবাই পালন করতে পারে। প্রয়োজনে শ্রেণি বিন্যাস করা যেতে পারে। তা না হলে এ আইন পরিপালন করবে না।
তিনি বলেন, প্রকৃতভাবে ই-কমার্স নীতিমালা করতে হলে সকল পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে বা আলোচনা করেই করতে হবে। নতুন বা ছোটরা ঝরে পড়ে যাবে। আর এ সুযোগ নিবে বিদেশি বড় কোম্পানিগুলো। নীতিমালা করতে গিয়ে যাতে দেশিও উদ্যোক্তাদের দাবিয়ে রেখে বিদেশিদের সুযোগ করে না দেই সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
নীতিমালায় পণ্যের স্টক উল্লেখ থাকার বিষয়ে জানাতে বলা হয়েছে। এটা ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, একজন ছোট উদ্যোক্তা অন্যের পণ্যের সাহায্য নিয়ে নিজে ব্যবসা করছে। সে কি করে পণ্যের স্টক তথ্য দিবে।
জানা যায়, ই-ক্যাবের সদস্য হতে গেলে কিছু কাগজপত্র জমা দিতে হবে। কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে টিন নম্বর, ট্রেড লাইনেন্স আর উদ্যোক্তার ছবি। সদস্য ফি ৫ হাজার ২০০ টাকা। বর্তমান ই-ক্যাবের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। তবে সারাদেশে ই-কমার্স করে ২০ হাজারেও বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তা। সম্পাদনা : ভিকটর রোজারিও