ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বিনম্র চিত্তে স্মরণ করেছে জাতি
অর্থনীতি ডেস্ক : কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিতে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে যথাযথ শ্রদ্ধা ও মর্যাদায় ভাষা শহীদদের স্মরণের মাধ্যমে ‘মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করেছে জাতি। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছরও পূর্ণ হয় এদিন।
রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি এদিন শ্রদ্ধা জানিয়েছে। রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে একুশের কর্মসূচি শুরু হয়। এছাড়াও কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরি সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা জানানো হয়। শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী প্রদান করেছেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ২১ ফেব্রæয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে, আওয়ামী লীগ সভাপতির পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলির সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও কর্নেল (অব) ফারুক খান, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা জি.এম কাদের, তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের মহাপরিদর্শক, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) প্রধান এবং আনসার বাহিনী প্রধান পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া বিএনপি, জাসদ, ন্যাপ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারবৃন্দ, বিদেশি সংস্থার প্রধানগণ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সেসব ভাষা আন্দোলনের বীরদের ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে খালি পায়ে হেঁটে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফুল দিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি’ গানে গানে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।
বাঙালি জাতির জন্য এ দিবসটি হচ্ছে চরম শোক ও বেদনার। অন্যদিকে, মায়ের ভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত। যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার-মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি শহীদরা জাতিকে সে মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে অস্বীকার করে। পাকিস্তানের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও ঢাকার সাধারণ মানুষ রাজপথে নেমে আসে।
বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও যুবসমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠির চোখ-রাঙানি ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিকসহ আরো কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।
একুশে ফেব্রæয়ারি সরকারি ছুটি। এদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঠিক নিয়মে, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন প্রতিনিধি হিসেবে ও ব্যক্তিপর্যায়ে একসাথে সর্বোচ্চ দুইজন শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শহীদ মিনারের সকল প্রবেশমুখে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন ও লিকুইড সাবান রাখা হয়। মাস্ক পরা ব্যতিরেকে কাউকে শহীদ মিনার চত্বরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং দিবসটি পালনে নিয়োজিত সকল প্রতিষ্ঠান ও সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়। দিনটি উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল এবং রেডিওগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান স¤প্রচার করছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে জাতীয় অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতি রেখে বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে দেশের সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানির আয়োজনসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। সূত্র : ইউএনবি, বাসস। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও, রেজা