ই-বর্জ্য বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা আসছে বিধিমালা
প্রিয়াংকা আচার্য্য : শিল্পায়নের ফলে মানুষ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তিমুখী। এরমধ্যে করোনার ফলে গত এক বছরে প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বহুগুনে বেড়েছে। দি গেøাবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর ২০২০ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-এ গোটা বিশে^ ৫ কোটি ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য ফেলা হয়েছে। যা থেকে রিসাইকেল করা হয়েছে মাত্র ১৭.৪ শতাংশ। চীন ১ কোটি ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য নিয়ে তালিকার প্রথমে আছে। যুক্তরাষ্ট্র ৬২ লাখ টন ই-বর্জ্য নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয়ে আছে ভারত। বছরে তাদের ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ৩২ লাখ টন। ভারতে ই-বর্জ্য পরিশোধনে ৩ শতাধিক রেজিস্টার্ড কোম্পানি রয়েছে।
২০১৮ তে বাংলাদেশে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ৪ লাখ টন, যা ২০৩৫-এ গিয়ে ৪৬ লাখ টনে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার দিন দিন বাড়বেই। এটা ঠেকানো যাবে না। তাই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আওতাধীন করতে হবে। এ খাতে অনেকে কাজ করে কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে পারবে। বুয়েটের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ই-বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে সোনা, রূপা, তামা, প্যালাডিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়ামসহ মূল্যবান ধাতু মিলে। উৎসভেদে প্লাটিনাম পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাণিজ্যের অপার সুযোগ রয়েছে। তবে তা যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় না নিলে সংশ্লিষ্টরা শারীরিক ক্ষতিসহ নানান সমস্যায় পড়বে।
যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জাব্বার বলেন, ইতিমধ্যে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ই বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের বেশ কিছু ফ্যাক্টরি আছে যারা এই ই বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করার পরে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে এনে সেগুলো এক্সপোর্ট করে। ফলে রিসাইক্লিংটা একটা পজিটিভ সাইট। তবে আমার মতে এটা খুবই সীমিত পর্যায়ে। হয়তো ৬ বা ৭টা ফ্যাক্টরি এ কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ ই বর্জ্য উৎপাদিত হয়, সে পরিমাণ বর্জ্য মোকাবেলা করার জন্য যে প্রচেষ্টা গ্রহণ করা দরকার, সে প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা আছে।
‘বিশেষ করে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত বিষয়গুলো থাকে। ই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসা উচিত। আমার মনে হচ্ছে, আমরা এটার গুরুত্বটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে, এটা কি পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে।’
‘এটা শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশ বা প্রকৃতি না, আমাদের জমিজমা থেকে আবাসস্থল পর্যন্ত সমস্ত কিছুতেই প্রভাব পরতে পারে। একই সঙ্গে যারা এখানে এই পণ্যগুলো এনে বিক্রি করে, তাদেরও যতোটা যতœবান হওয়া উচিত ছিল ততোটা হয়নি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত আলী বলেন, ‘২০১১-তে ই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিধিমালা করতে আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়। অনেক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর ২০১৮ তে আমরা এটা আপডেট করি। আরও অনেক প্রসিডিওরের পর আমরা ডবিøইউটিও-তে এটি দিতে যাচ্ছি ফাইনাল রেসপন্সের জন্য। ফাইনাল রেসপন্সটা আমরা একটা গেজেট করার প্রক্রিয়াতে আছি।’
‘আশা করছি, দু’এক মাসের মধ্যেই গেজেটটা হয়ে যাবে। যে রুলসটা আমরা খসড়া করেছি, তা এমনভাবে করা যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’ মনে করছি, এ বিষয়ে আইন থাকা উচিত। ডিপার্টমেন্ট অব ইনভায়রনমেন্ট নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এ ধরনের আইন খসড়া হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেটা চ‚ড়ান্ত করা হয়নি।’
অর্থনীতিবিদ ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ই-বর্জ্য একটা বৈশি^ক সমস্যা। বাংলাদেশ এমনিতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা আক্রান্ত। ফলে এটা আমাদের জন্য আরও বিপদজনক।’
‘বর্তমানে যেসমস্ত নারী-শিশুরা এ খাতে কাজ করছে তারা সরাসরি শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে কতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর মাধ্যমে যে কত অকাল মৃত্যু ঘটবে তা হিসেব করার ব্যবস্থাও আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত কেউ চিন্তাও করতে পারে না।’
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শ্রমিক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘৩০ বছর ধরে এ কাজে জড়িত। অনেক শারীরিক সমস্যা হয়। দেখা যায়, দুই দিন বা পাঁচ দিন কাজ করলে পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে যায়। নানা অসুখ তৈরি হয়ে যায়।’
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মো. শহীদ উল মুনীর বলেন, ‘এসডিজি অর্জনের যে লক্ষ্যগুলো আছে সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উল্লেখ আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০৪১-এর ধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার ক্ষেত্রে ই বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনার বিষয়টা আছে। ই বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করলে আমাদের জন্য বড় রকমের একটা রেভিনিউরও ব্যাপার চলে আসবে।’
‘ই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি ও বেসরকারি দুইভাবেই কাজ করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে বড় হার্ডওয়্যার ম্যানুফ্যাক্টচারার কোম্পানিগুলো তাদের পুরনো পণ্যগুলো এক্সচেঞ্জ করার মাধ্যমে ব্যাক করে নিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশে তা করার জন্য ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে ই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে।’
আজিজু রিসাইকেল ফ্যাক্টরির সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এদেশে প্রথমবার ২০১৩ সালে আমরা যাত্রা শুরু করি। এর আগে কাজ করেছি সিঙ্গাপুরে। তখন জেলা পর্যায়ে গিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছি যে, এই বর্জ্যগুলো আমাদের দাও। আমরা কিনে নিব। এক্ষেত্রে আমরা দুই-তিন জায়গায় মার্কেটও করেছি। তারপর এগুলো সংগ্রহ করে সিঙ্গাপুরে পাঠাতাম।’
‘এরপর গ্রামীণ ফোন কোম্পানি বাংলাদেশেই একটা পূর্ণাঙ্গ কোম্পানি করতে সহায়তা করে। দিনে আমরা ১০ টন ই-বর্জ্য রিসাইকেল করতে পারি। ১০ টন যদি রিসাইকেল করি তাহলে ৩ টনের মতো মেটাল পাই।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল বলেন, ‘আমরা পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলি। কিন্তু পার্টিকুলারলি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কি করা যেতে পারে, সেজন্য সমন্বিত কোন পরিকল্পনা আমরাও সরকারকে জানাতে পেরেছি বলে আমি মনে করি না।’
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে ইমপোর্ট পলিসি খুব আনরেগুলেটেড। এতে অল্প টাকায় সাব স্ট্যান্ডার্ড পণ্য আসছে। ফলে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। সরকার এবং নাগরিক সমাজকে সচেতন করে স্থায়িত্বশীলতা অর্জনে কাজ করতে হবে।