দেশে জঙ্গিদের সংগঠিত হওয়ার কোনও শক্তি নেই
প্রিয়াংকা আচার্য্য : বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত কেটে গেছে প্রায় ২০ বছর। এরই মাঝে বহির্বিশে^ জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিলে প্রভাব পড়ে এখানেও। পর পর কয়েকটি ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তটস্থ করে তোলে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিসানে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটায়। ঘটনার পর বিশ^ব্যাপী উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হলে গত কয়েক বছর ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের নেতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। ফলে দেশে জঙ্গি কার্যক্রম অনেকটাই কমে আসে। বর্তমানে দেশে জঙ্গিবাদের পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে এক সাক্ষাৎকার দেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) প্রধান এবং অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
বহির্বিশে^ বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রকাশিত অধিকাংশ রিপোর্টই নেতিবাচক দেখা যায় এর কারণ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব রিপোর্ট অতিরঞ্জিত। অধিকাংশ রিপোর্টের তথ্য নেয়া হয় ওপেন সোর্স থেকে। অর্থাৎ মিডিয়া ও আমাদের দেশে টেরোরিজমের ওপর কাজ করে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আবার বাইরের ফান্ডের লোভে বাংলাদেশে এ সমস্যাটি প্রবল তা দেখাতে চায়। এজন্য নেতিবাচক প্রচারণা বেশি। ছোট বিষয়টা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। অথচ গেøাবাল টেরোরিজম ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান এবার আগের বছরগুলোর চেয়ে ভালো। দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে একমাত্র ভুটান। অন্যান্য দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত আছে তালিকার প্রথম দশে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে আমাদের পেছনে রয়েছে।’
জঙ্গিদের প্রধান মেজর জিয়া কেন এখনও অধরা রয়ে গেছে এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ সে সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয়। তার দলের কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। যদি হতো, তাহলে আমাদের টিম কোনও না কোনভাবে খবর পেতো। জিয়া তার সর্বশেষ কাÐটি ঘটিয়েছে ২০১৬-র এপ্রিলে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে হত্যা করে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আনসারুল ইসলাম কোনও তৎপরতা দেখাতে পারেনি। এ থেকেও প্রমাণ হয় সে নিষ্ক্রিয় আছে।’
দেশের জঙ্গিরা কী অবস্থানে আছে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘জঙ্গিরা বিচ্ছন্নভাবে রয়েছে। কোন বড় বা মাঝারী ধরনের ঘটনা ঘটানোর সক্ষমতা তাদের নেই। বর্তমানে জঙ্গি গোষ্ঠী অনলাইন ছাড়া তেমনভাবে সক্রিয় নেই। কারণ তাদের সাংগঠনিক ভিত্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অনলাইনে তাদের কিছু তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। তবে ২০১৯-এ পুলিশকে লক্ষ্য করে কিছু হামলার চেষ্টা হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮টি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনও এখন নিষ্ক্রিয় আছে। তবে নব্য জেএমবি, আনসারুল ইসলাম, হিজবুত তাহেরি অনলাইনে কিছুটা সক্রিয়।’
এদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের উত্থানের কয়েকটি পর্ব রয়েছে। প্রথম পর্বে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ২০০৪ সালে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর গ্রেনেড হামলা বা ঐ সময়ে উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে বাগমারায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় সরকারি দলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। ২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।’ ‘২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে জামায়েতে ইসলামকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দাবি উঠে। ফলে আন্দোলনরত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বøগারদের নাস্তিকতার তকমা দিয়ে তাদের হত্যা করা শুরু হয়। তখন বøগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়।’
‘২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইএস’র উত্থান হয়। আল কায়দা তাদের ভারতীয় শাখা একিউআইএস ঘোষণা করে। এতে ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিবাদ আবারও মাথা চাড়া দেয়। যদিও এর আগের বছর দেশীয় জঙ্গিরা একজন বøগারকে হত্যা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। রাজীব হায়দারকে হত্যাকারী জঙ্গিরা ধরা পড়ে। তাদের আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দি রাহমানীও সেসময় ধরা পড়ে।’
‘২০১৫ সালে বেশ কয়েকজন বøগারসহ মাজার অনুসারীদেরও টার্গেট করে হত্যা করা হয়। শিয়া মসজিদে হামলা চালানো হয়। ২০১৬ সালের জুলাই পর্যন্ত অন্য ধর্মের যেমন- হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্মালম্বী বা বিদেশীদেরও টার্গেট করে হত্যা করা হয়। হোলি আর্টিসানে হামলা বা শোলাকিয়ায় হামলা চেষ্টাকালীন সময় দেশে জঙ্গিবাদের পিক সময় হিসেবে ধরা হয়।’
‘এমন সব ঘটনার ফলে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ রোধে জিরো টলারেন্স নীতি পুর্নব্যক্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশ দেন। পাশাপাশি তিনি দেশের সাধারণ মানুষকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহŸান জানান। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও জনগণের স্বতঃস্ফ‚র্ত সমর্থনে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আসে। একের পর এক ঘটনা ঘটার আগেই আমরা তা নিষ্ক্রিয় করতে থাকি। তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হই। ’
‘২০১৭ সাল পর্যন্ত জঙ্গিবাদ দমেন অনেকগুলো অভিযান চালানো হয়। শুধু সিটিটিসর পক্ষ থেকে ১৯টি হাই রিস্ক অপারেশন পরিচালিথ হয়, যেখানে ৬১ জন জঙ্গি মারা যায় এবং প্রচুর সংখ্যক গ্রেপ্তার হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে জঙ্গিরা নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। ২০১৮-তে শাজাহানপুরের বাচ্চু হত্যার মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের একটি অ্যাটেম্পট কার্যকর হয়। ২০১৯ বা ২০-এ কেউ মারা যায়নি।’
মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সীমারেখা কোথায় টানা উচিৎ জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের সংবিধান বা ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অফ হিউম্যান রাইটসে স্বাধীনতার সংজ্ঞাও অনেক ক্লজ, সাবক্লজ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত দায়িত্বশীলতা। কারও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি কাউকে আহত বা আঘাত করে, সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রে সীমা রেখা টানার কথা আমাদের সংবিধানে আছে, ইউনিভার্সাল ডিক্লেয়ারেশন অফ হিউম্যান রাইটসেও আছে। কেউ যদি মত প্রকাশ করতে গিয়ে অযৌক্তিকভাবে কাউকে বা কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীকে আহত করে তবে সেলফ সেন্সরশিপ আনতে হবে। আপনারা জানেন, সম্প্রতি জঙ্গিদের দ্বারা নিহত দুজন মুক্ত চিন্তক হত্যার রায় দেয়া হয়েছে। এ রায় দেখে আমি মনে করি, এর মধ্য দিয়ে যারা মুক্তভাবে মত প্রকাশে ভয় পাচ্ছিলেন তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন। আর এর মধ্য দিয়েও এটাও প্রমাণ হয় যে, দেশের প্রচলিত আইনে যতো সুকৌশলেই অপরাধ সংঘটিত হোক, শাস্তি পাবেই। ’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। আপনারা যখন আইনটি প্রয়োগ করেন তখন কোন্ বিষয়টির ওপর নজর রাখেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োগ আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করি না। কেউ যদি বাদী হয়ে কারও বিরুদ্ধে মামলা করে, তবে আমরা আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’ বিভিন্ন সময়ে দেশের বাইরে গিয়ে যারা জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীন কী ধরনের ভ‚মিকা পালন করছে জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘২০১৫ সালের পর বাংলাদেশীরা দেশের বাইরে অর্থাৎ গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ তেমন পায়নি। যারা সেসময় গিয়েছিল তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। সুতরাং বৈধভাবে দেশে আসার সুযোগ তাদের নেই। আর বাইরে গিয়েও অনেকে ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে, সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। সুতরাং তাদের বিষয়ে আমাদের কড়া নজরদারি আছে।’
জঙ্গিবাদ চালু রাখার অর্থ আসে কোথা থেকে এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ধরনটি ছিল ‘লো কস্ট টেরোরিজম’। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল ইসলাম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো চাপাতি। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার সক্ষমতাও তাদের ছিল না। দলের কতিপয় বিত্তবানরা ব্যক্তিগতভাবে ফান্ড দিতো। জঙ্গিরা মূলত তাদের ভ্রান্ত আদর্শের কারণে এ ধরনের কাজ করে থাকে। আমরা জেনেছি যে, ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাÐে ঘটায় তাদের একেকজনকে প্রণোদণা দেয়া হয়েছিল মাত্র ২ হাজার টাকা।’
‘তবে এদেশের জঙ্গিবাদে মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য দেশ থেকে কোটি কোটি টাকার ফান্ড আসার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালের একটা ঘটনা আছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সাইফুল হক সুজন যুক্তরাজ্য থেকে সন্ত্রাসী সংগঠনে দেয়ার জন্য ৫০ হাজার ডলার তার বাবাকে পাঠালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। এর কিছুদিন পর সাইফুল সিরিয়ায় ড্রোন হামলায় মারা যায়। আর তার বাবার মৃত্যু এখানকার জেলেই হয়।’
‘এর আগের জঙ্গিদল যেমন- জেএমবিরা সরাসরি ডাকাতি করে অর্থ উপার্জন করে তা সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করতো। পরে নব্য জেমএমবি কথিত হিজরত করতো। এখানেও কিছু বিত্তবান জড়িত ছিল। যাদের ব্যাক্তিগত টাকা জঙ্গিবাদে ব্যবহার করা হতো।’
জঙ্গিবাদ চিরতরে দমনে আমাদের কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত জিজ্ঞেস করলে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘একটি জরিপে দেখা গেছে, এখানে যারা জঙ্গি কর্মকাÐে জড়িত তাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। মাদ্রাসা কম, গ্র্যাজুয়েশন লেভেলে বেশি। তাদের মধ্যে জঙ্গির বীজ বোনা হয়েছে সাইবার মাধ্যমে। এ জায়গাটা আমাদের নজরে রাখতে হবে। পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে, তাদের সন্তান কোন পথে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
‘তারুণ্যে শক্তি যেন বিপথে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শৈশব থেকেই তাদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মাতৃভাষা দিবসের মাহাত্ম, সর্বোপরি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানাতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাদের ওয়াকিবহাল করতে হবে। তাহলেই এদেশে চলমান সময়ের পাশাপাশি সুদূর ভবিষ্যতেও জঙ্গিবাদ আর কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।’