বছরে অপচয় হয় ৬ লাখ টন পেঁয়াজ
মতিনুজ্জামান মিটু : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফরিদপুরের মসলা গবেষণা উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলাউদ্দিন খান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মুশফিকুর রহমান জানান, খরিপ মৌসুমে উৎপাদিত পেঁয়াজে স্বভাবতই পানির পরিমাণ বেশি থাকে। স্টোরে এ মৌসুমের পেঁয়াজের অঙ্কুরোদগম ও পচন হার খুবই বেশি। এ পেঁয়াজ দেড় থেকে দুই মাস সংরক্ষণ করলে শতকরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। তাই খরিপ পেঁয়াজ সংরক্ষণ না করে বাজারজাত করাই ভালো। রবি পেঁয়াজে পানির পরিমাণ কম থাকে। এ পেঁয়াজ দীর্ঘদিন অর্থাৎ ৮ থেকে ৯ মাস সংরক্ষণ করা যায়। এ সময়ে রবি পেঁয়াজের ৩০ থেকে ৪০% নষ্ট হয়ে যায়।
উপযুক্ত ব্যবস্থাপনায় চাষ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনায় পেঁয়াজ সংরক্ষণ করলে কৃষক ব্যাপকভাবে লাভবান হতে পারে। পেঁয়াজ উৎপাদন ও সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত কৃষি প্রযুক্তি প্রয়োগ না করার কারণে উৎপাদিত পেঁয়াজের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় হয়ে যায়। এমনকি পেঁয়াজের গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যায়। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে এ ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি হয়ে থাকে। যা পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলাদেশে বছরে ১৮ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়ে থাকে। বছরে পেঁয়াজ অপচয়ের পরিমাণ প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য, সরকার দেশের পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর লক্ষে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। গুণগতমান বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্টোরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে সঠিক মূল্যে বিক্রয় করা ও বাজার স্থিতিশীল রাখা সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য। এছাড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণের মাধ্যমে ভোক্তার নিকট বছরব্যাপী পেঁয়াজ সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়ে থাকে। পেঁয়াজের প্রকৃত বীজ সাধারণত বীজ কন্দ থেকে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বীজ কন্দকে ভালো রাখাও সংরক্ষণের আরেকটি উদ্দেশ্য। স্টোরে পেঁয়াজ জীবিত অবস্থায় থাকে। তাই পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় (প্রস্বেদন, শ^সন, অংকুরোদগম/মূল গজানো, পেঁয়াজের খোসা খসে পড়া) এবং বিপাকীয় (এনজাইমের কার্যকারিতা, টিস্যু নরম হওয়া) কার্যক্রম চলতে থাকে। ভালো কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ ও উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পেঁয়াজের শারীরবৃত্তীয় ও বিপাকীয় কার্যাবলী বন্ধ করে বা নিম্ন পর্যায় রেখে এবং ছত্রাক/ব্যাকটেরিয়ার কার্যকারিতাকে বন্ধ করে বা সুপ্তাবস্থায় রেখে পেঁয়াজের সংরক্ষণ কালকে বাড়ানোই পেঁয়াজ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মূল চ্যালেঞ্জ। পেঁয়াজের সংরক্ষণজনিত ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায় রাখা এবং সংরক্ষিত পেঁয়াজের গুণগতমান বজায় রাখার জন্য প্রযুক্তি প্রয়োগ করা জরুরি।
পেঁয়াজ বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের খাবারের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। ফলে চাহিদার ভিত্তিতে (জনপ্রতি দৈনিক ৩৫ গ্রাম) মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ প্রথম স্থান অধিকার করে আছে। উৎপাদনের বিবেচনায়ও এ মসলা ফসলটি প্রথম স্থানে আছে। কিন্তু পেঁয়াজ একটি পচনশীল পণ্য। সংগ্রহ মৌসুমে পেঁয়াজ এর ব্যাপক সরবরাহ থাকার কারণে কৃষক খুবই কম মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রয় করে থাকে।
সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের পচন, অঙ্কুরোদগম ও ওজন হারোনোর পরিমাণ জাতভেদে কম বেশি হয়ে থাকে। দৃঢ় ও আঁটসাঁটে, ঝাঁঝ বেশি, পানি কম, আকারে মধ্যম, গলা চিকন, উচ্চ শুষ্ক পদার্থ সম্বলিত বৈশিষ্ট্যের জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা বেশি। বারি পেঁয়াজ-১, বারি পেঁয়াজ-৪। হাইব্রিড জাত অপেক্ষা স্থানীয় জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতা ভালো। যে পেঁয়াজের শুষ্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বেশি থাকে সে পেঁয়াজের সংরক্ষণকাল বেশি হয়। কিউরিং করলেই শুস্ক শল্কপত্রের পরিমাণ বাড়ে। হলুদ ও সাদা রংবিশিষ্ট জাতের পেঁয়াজের তুলনায় লাল রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের ফিনোলিক এসিড, এন্থোসায়ানিন, ফ্লাভোনয়েড (কুয়েরসিটিন, ক্যাম্পফেরল), পলিফেনল নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। বারি পেঁয়াজ-৪ জাতের পেঁয়াজে এন্টিঅক্সিডেন্ট বেশি থাকে। তবে লাল রং এবং সাদা রং বিশিষ্ট পেঁয়াজের তুলনায় হালকা লাল রং বারি পেঁয়াজ-১ বিশিষ্ট পেঁয়াজে শ^সন হার কম হয়। রোপণ পদ্ধতি হালি পেঁয়াজের (চারা থেকে পেঁয়াজ চাষ) তুলনায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ (ছোট কন্দ থেকে পেঁয়াজ চাষ) অত্যধিক ফুল হওয়ার কারণে মুড়িকাটা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না। মুড়িকাটা পেঁয়াজে পানির পরিমাণও বেশি থাকে। অতি আগাম পেঁয়াজের চারা রোপণ করলে প্রায় ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ গাছে ফুল আসতে পারে। যা সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। পেঁয়াজের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় কার্তিক মাসের ১৫ থেকে ৩০ (নভেম্বর ১ থেকে ১৫) তারিখ। পেঁয়াজের রোপণ দূরত্ব বেশি হলে গলা মোটা হয়ে যায় এবং পেঁয়াজ ফেটে যায়। সরাসরি বীজ বপনকৃত পেঁয়াজের তুলনায় চারা রোপণ পদ্ধতিতে উৎপাদিত পেঁয়াজে তুলনামূলকভাবে বোল্টার (ফুল উৎপাদনকারী কন্দ) ও বহুকোষী পেঁয়াজের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে বরাতে কর্মকর্তাদ্বয় জানান, সাধারণত ৩০ টন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য এ ফসলটি হেক্টরপ্রতি ৮৫ কেজি নাইট্রোজেন, ৩৬ কেজি ফসফরাস এবং ৬৮ কেজি পটাশ মাটি থেকে গ্রহণ করে থাকে। তাই জমির ধরন বুঝে পর্যাপ্ত রাসায়নিক সার দেওয়া দরকার। অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার (ইউরিয়া) দিলে পেঁয়াজের গলা মোটা হয়ে যায়, পেঁয়াজ ফেটে যায় এবং সংরক্ষণাগারে পেঁয়াজের অঙ্কুরোদগম হয় ও পচে যায়। গলা মোটা পেঁয়াজের রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। পেঁয়াজ সংগ্রহের ২৫ থেকে ৩০ দিন আগেই নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। এ সময়ের ভিতর নাইট্রোজেন সার উপরি প্রয়োগ করলে ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে সংরক্ষণাগারে বাল্ব পচে যায়। পেঁয়াজ চাষে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন দিলে স্টোরে পেঁয়াজের আগাম অঙ্কুরোদগম হয়ে যায়। কোন কারণে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার দিতে থাকলে পরবর্তীতে পটাশ সার (এমওপি) দিলে পচনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। তাছাড়া পটাশ সার প্রয়োগে কার্বহাইড্রেট ভাঙনকারী এনজাইমের কার্যকারিতা কমিয়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। পটাশ সার অঙ্কুরোদগম ও পানি অপচয় রোধেও সহায়তা করে।
প্রয়োজনমতো ফসফরাস সার (টিএসপি) দিলে সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। ফসফরাস সার বেশি দিলে পেঁয়াজ বহুকোষী হয়ে যায়। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও