প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বের ১৪০ কোটি মানুষের জীবিকা মৌমাছির পরাগায়নে বছরে উৎপাদন ২২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের খাদ্য
মতিনুজ্জামান মিটু : প্রতিদিন মানুষ যে খাবার খায়, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে মৌমাছির পরাগায়ন থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. আবদুল মুঈদ আরও জানান, পরিসংখ্যানের দিক থেকে, কীটপতঙ্গের মাধ্যমে যেসব উদ্ভিদের পরপরাগায়ন হয় তাতে শুধু মৌমাছির অবদানই শতকরা ৮০ ভাগ (অন্তত ১ লাখ ৩০ হাজার উদ্ভিদ)। বর্তমানে মানুষ খাবার হিসেবে যে ফলমূল, শাকসবজির ওপর বেশি নির্ভরশীল সেগুলোর শতকরা ৭০ ভাগ উৎপন্ন হয় মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে। পৃথিবীতে প্রতি বছরে যে পরিমাণ খাদ্য মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় সেগুলোর আর্থিক মূল্য আনুমানিক ২২ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী ১৪০ কোটি মানুষের জীবিকা।
বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাবারের জোগান দিতে দরকার বাড়তি উৎপাদন। মৌমাছির সহায়তা ছাড়া যা এক প্রকার অসম্ভব। তাই মৌমাছির জীবন হুমকির মুখে পড়লে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও হুমকির মুখে পড়বে। আর একটি মৌচাকে যত মৌমাছি বাস করে তার চারপাশে ৪ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে যত ফুল ফোটে, একদিনে সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ ও পরাগায়ন করতে সাহায্য করে এসব মৌমাছি। মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন হয় এমন ফল ও সবজির তালিকা অনেক লম্বা। যেসব ফল ও সবজি উৎপাদনে মৌমাছির প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে সেগুলোর মধ্যে আলু, পেঁয়াজ, সরিষা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, মরিচ, পেঁপে, বাদাম, তরমুজ, কমলা, আঙুর, কুমড়া, লেবু, গাজর, লিচু, আপেল, আম, শিম, টমেটো অন্যতম। রাজশাহী, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর প্রভৃতি জেলায় লিচু, আম, সরিষার মধু প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। গোপালগঞ্জ আবার কালোজিরা ও ধনিয়া মধুর জন্য বিখ্যাত। মধুর জন্য নাম রয়েছে টাঙ্গাইলের লালমাটির মধুপুর এলাকার মধুপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়ীয়া, ঘাটাইল, সখীপুর, ভালুকা ও জামালপুর সদর উপজেলায় আনারস, কাঁঠাল, কলা, সরিষা, তিল, তিসি, জলপাই, লিচু, আম, পেঁপে, কুল, আদা, হলুদ, মিষ্টিকুমরা, লাউ, শিম, আলু, কাসাভা, কপি, গাজর, মুলাসহ বিভিন্ন কৃষিজ ফসল বাণিজ্যিকভিত্তিতে উৎপাদন করা হয়। ফলে এসব এলাকায় রয়েছে অনেক মৌচাষি। বীজ ও ভালো ফসল উৎপাদনে পরাগায়ন অত্যাবশ্যক, বীজ ফসলের মাঠে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন অধিক কার্যকর।
প্রাচীনকাল থেকেই মৌমাছি মানুষের কাছে সামাজিক পতঙ্গ হিসেবে পরিচিত কারণ এরা দলবদ্ধভাবে বাস করে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন এর মতে, গবেষণা থেকে পাওয়া যে মৌমাছিরা ফুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বাড়িয়ে দেয়। উৎপাদিত বাড়তি ফসলের মূল্য মোট উৎপাদিত মধু ও মোমের মূল্যের ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি। মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালন করাই মূলত মৌমাছি পালন। একটি মৌচাকে গড়ে প্রায় ২০ হাজার মৌমাছি থাকে। একটি চাকে সাধারণত ৩ শ্রেণির মৌমাছি থাকে একটি রানী মৌমাছি যা প্রজননে অংশ নেয়; ড্রোন বা পুরুষ মৌমাছি, কর্মী মৌমাছি। রানী মৌমাছি সবচেয়ে বড় প্রকৃতির। একটি চাকে একটি মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। এর একমাত্র কাজ ডিম পাড়া। পুরুষ মৌমাছি মধ্যম আকৃতির ও এদের চোখ বড় কিন্তু হুল নেই, একমাত্র কাজ রানীর সাথে মিলিত হওয়া। শ্রমিক মৌমাছি সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির। এদের চোখ ছোট, কিন্তু হুল আছে। রানী ও পুরুষ বাদে অবশিষ্ট সব সদস্যই শ্রমিক মৌমাছি। এরা নানা দলে ভাগ হয়ে চাকের যাবতীয় কাজ যথা- চাক নির্মাণ করা, ফুলের মিষ্টি রস ও পরাগরেণু সংগ্রহ করা, মধু তৈরি করা, চাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, চাকে বাতাস দেয়া চাক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করে।
বাংলাদেশে পাঁচটি প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়- অ্যাপিস মেলিফেরা, এ. সিরানা, এ. দোরসাতা, এ. ফ্লোরিয়া ও ট্রিওগোনা। এর মধ্যে অ্যাপিস মেলিফেরা প্রজাতির চাষাবাদ এ দেশের প্রেক্ষাপটে লাভজনক। ইউরোপীয় জাতের অ্যাপিস মেলিফেরা আকারে মাঝারি ও শান্ত প্রকৃতির, তাই এদের বাক্সে লালন-পালন করা যায়। এ. সিরানা ও এ. ফ্লোরিয়া গাছের ফোকর, দেয়ালের ফাটল, আলমারি, ইটের স্তূপসহ বিভিন্ন অন্ধকার স্থানে চাক বাঁধে। চাকপ্রতি মধুর উৎপাদন প্রতিবারে গড়ে প্রায় ৪ কেজি। এ. দোরসাতা প্রজাতির মৌমাছি পালন করা যায় না কারণ খুব হিংস্র স্বভাবের, বন-জঙ্গলে এদের চাক দেখা যায়, সুন্দরবনে এদের বেশি দেখা যায়। ট্রিওগোনা প্রজাতি প্রকৃতিতে ও পাহাড়ি এলাকায় পাওয়া যায়।
ফসল ও পরাগায়নের ধরন অনুযায়ী মৌমাছির বাসা নির্বাচন করা হয়। বাঙ্গি ফসলে ১০টি ফুলের জন্য একটি মৌমাছি যথেষ্ট। শসা, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া আর লাউয়ের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ ফুলের জন্য একটি মৌমাছির উপস্থিতির দরকার হয়। বাঁধাকপি, ফুলকপি প্রভৃতি ফসলের ক্ষেত্রে হেক্টরপ্রতি ফসলের (বীজ) জন্য দুটি বা তিনটি মৌমাছির বাসা মাঠের উপযুক্ত স্থানে বসিয়ে দিলেই পরাগায়ন নিশ্চিত হয়। মুলার ক্ষেত্রে যেহেতু ফুল একেবারেই আকর্ষণীয় নয়, সেজন্য মাঠে অধিক সংখ্যক কীটপতঙ্গের উপস্থিতির দরকার হয়। তাই প্রতি হেক্টর মুলার জমিতে তিন-চারটি মৌমাছির বাসা মাঠে বসিয়ে দিলে বীজের পরিমাণ অনেক বাড়ে। পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যক মৌমাছির উপস্থিতির দরকার হয়। এক থেকে ১০ হেক্টর পেঁয়াজের ফসলের (বীজ) মাঠে একটি মৌমাছির বাসা বসিয়ে দিলেই চলে। গাজরে একই সঙ্গে বায়ু পরাগায়ন ও কীটপতঙ্গ পরাগায়ন সম্পন্ন হয়। তবে মৌমাছি গাজরের পরাগায়নে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে। প্রতি হেক্টর গাজরের জমিতে একাধিক মৌমাছির বাসা স্থাপন করলে ভালো কাজ হয়। ধান সাধারণত বায়ু পরাগায়নে নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতের পাশে মৌ বাক্স বসালে ধানের ফলন অন্য ক্ষেতের চেয়ে বেশি হয়।