করোনায় গত বছর ৭০ ভাগ চাকরিজীবীর আয় কমেছে
সোহেল রহমান : করোনার কারণে গত বছর ৭০ শতাংশ চাকরিজীবীর আয় কমেছে। আগামীতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও প্রায় ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আর কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে যাবে না।
‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম) ও ‘একশনএইড বাংলাদেশ’-এর সাম্প্রতিক এক যৌথ এক জরিপে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘মহামারি এবং বাংলাদেশের যুব জনগোষ্ঠী : চারটি নির্বাচিত জেলার জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক এ জরিপে গত ১৩ থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বরগুনা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও কুড়িগ্রামের ১,৫৪১টি খানার ওপর জরিপ চালানো হয়েছে। জরিপে তরুণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী ইত্যাদির ওপর করোনা মহামারীর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে ।
এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণদের মধ্যে নাগরিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণের প্রবণতা, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত সচেতনতার মাত্রা অনুধাবন, জেন্ডার বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যু যেমনÑ নারীর প্রতি সহিংসতা, নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন এবং বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তিতে নারীর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নভেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের নভেম্বরে জরিপকৃত চারটি জেলায় মজুরি বা বেতনভুক্তদের কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশের আয় কমেছে, ২৮ শতাংশের আয় অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ২ শতাংশের আয় বেড়েছে। স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত মধ্যে এই সময়কালে লাভ কমেছে ৮২ শতাংশের, অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫ শতাংশের এবং বেড়েছে ৩ শতাংশের। স্ব-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত এই চারটি জেলায় করোনার সময়ে ব্যবসা বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হয়েছে ৩১ শতাংশের।
জরীপে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলে নিয়মিত পড়াশুনায় ফিরবেন না কিংবা এ বিষয়ে অনিশ্চয়তা আছেÑ এমন মত দিয়েছেন এই চারটি জেলার ৩.৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী। ছেলে শিক্ষার্থীর মধ্যে এই হার ৩.৫২ শতাংশ এবং মেয়ে শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪.০৩ শতাংশ। গ্রামে এই হার ৪.৪১ শতাংশ এবং শহরে ১.৬৫ শতাংশ।
করোনার সময়ে অন-লাইন ক্লাসের সুযোগ পাননি এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কুড়িগ্রামে ৬২ শতাংশ, সাতক্ষীরাতে ৫৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩৯ শতাংশ এবং বরগুনায় ৪৬ শতাংশ। গড়ে এই চারটি জেলার ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী অন-লাইন ক্লাসের সুযোগ পান নি। এই চারটি জেলার ৫০ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পান নি, অপরদিকে ৫৬ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের সুযোগ পান নি। করোনাকালীন সময়ে এই চারটি জেলার ৫২ শতাংশ ছেলে শিক্ষার্থীর কোন ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না, অপরদিকে ৬৫ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীর কোন ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না। গড়ে এই চারটি জেলার ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থীর কোন ডিজিটাল ডিভাইস ছিল না।
এই চারটি জেলার লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার চিত্র বোঝার ক্ষেত্রে জরিপকৃত খানাগুলির ১৫-৩৫ বছর বয়সী ১,২৭০ জন নারীকে প্রশ্ন করা হয়। জরিপের ৮৫ শতাংশ উত্তরদাতা গ্রামের এবং ১৫ শতাংশ শহরের। জরিপে অংশগ্রহণ করা ১৯ শতাংশ অবিবাহিত এবং ৮১ শতাংশ বিবাহিত। বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের স্বামীদের দ্বারা কোন্ ধরনের শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কুড়িগ্রামে এই হার ৪১ শতাংশ, সাতক্ষীরাতে ২২ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৮ শতাংশ এবং বরগুনায় ৫৫ শতাংশ। স্বামী ব্যতীত অন্য কারো মাধ্যমে শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ, অবিবাহিত নারীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ।
জরিপ ফলাফলের ওপর আলোচনায় ‘সানেম’-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে সরকারের উচিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে জোর দেয়া এবং ‘লেবার এন্ড এমপ্লয়মেন্ট কমিশন’ গঠন করা। গতানুগতিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর মাধ্যমে করোনাকালীন অভিঘাত মোকাবেলা সম্ভব নয়। তবে এর ব্যাপ্তি বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার কোন বিকল্প নেই।
‘একশনএইড বাংলাদেশ’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, দক্ষতা, জীবিকা, সামাজিক নিরাপত্তা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী ও তরুণ কেন্দ্রিক কর্মসূচির অভাব রয়েছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের অধিকতর সংযুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তরুণদের অধিকতর সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে কাঙ্খিত পরিবর্তনকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।