তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, ঢাকা এখন গ্লোবাল টেক্সটাইল মার্কেট
রাশিদ রিয়াজ : পাকিস্তানের সাময়িকী সাউথ এশিয়ার মার্চ সংখ্যায় ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ শিরোনামে চতুর্থ প্রবন্ধে মাজিদ আজিজ শুরুতেই সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বাংলাদেশকে নিয়ে সেই কুখ্যাত মন্তব্য ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র স্মৃতি স্মরণ করে বলেছেন ১৯৭১ সালের পহেলা ডিসেম্বর বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা ও ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ নিয়ে আয়োজিত একটি উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন হেনরি কিসিঞ্জার। স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা উরাল আলেক্সিস জনসন আদতে ওই কুখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন যে নতুন দেশটি একটি ‘আন্তর্জাতিক তলাবিহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হবে। মাজিদ দাবি করেন এই উক্তিটি নিয়ে কিসিঞ্জারকে ভুলভাবে দায়ী করা হয়েছে। তবে এই পটভূমি মনে করিয়ে দেয় কিভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল অপব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তুলনামূলকভাবে একটি সফল জাতি হয়ে ওঠার সংগ্রামের শুরুতেই বাংলাদেশকে সমস্ত নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পাঁচ দশক আগে কিসিঞ্জারের উক্তি হিসেবে পরিচিত ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহনী ঝুড়ি’ তিক্ত মনে হলেও আজ এটাই সত্যি যে ঢাকা এখন বিশ^ব্যাপী এক গ্লোবাল টেক্সটাইল মার্কেট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
২০২১ সালে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলি গত পাঁচ দশকে দেশে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা অভাবনীয়। দেশটির জিডিপি এখন ৩৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০০৪ সাল থেকে এর বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫% ছাড়িয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি ৫%, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, রেমিটেন্স ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ২০২০ সালে ছিল ২.৩৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, একই সঙ্গে রপ্তানি ও আমদানি ছিল যথাক্রমে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৪৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (মহামারীর কারণে ২০২০ সালে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে রপ্তানিতে ১% এবং আমদানিতে ৯% হ্রাস পেয়েছিল)।
বাংলাদেশের এই যাত্রায় কঠিনভাবে পথ চলতে সকলকে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। জাতিটি ঘূর্ণিঝড়ের বিপর্যয় ভোগ করেছে, দুর্ভিক্ষ ও ক্ষুধার্ততার মুখোমুখি হয়েছিল, বিশাল জনগোষ্ঠীর অবহেলিত দারিদ্র্য সহ্য করেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা সহ্য করেছে, সামরিক অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হয়েছিল এবং শিশুশ্রম, স্বল্প মজুরি এবং শ্রম অমান্য করার বিশ্বব্যাপী অভিযোগের মধ্য দিয়ে গেছে, বলা হয়েছে শ্রমিকের অধিকার প্রয়োজন। বাংলাদেশ এধরনের বেশিরভাগ প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠেছে এবং এখন একটি স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কী কী বাংলাদেশের দর্শনীয় প্রবৃদ্ধিকে পরিচালিত করেছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হান পাঁচটি প্রধান অর্জনকে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। (ক) তৈরি পোশাকের রপ্তানি (খ) অভ্যন্তরীণ রেমিটেন্স বৃদ্ধি (গ) কৃষিতে টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং (ঙ) বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পে জনসাধারণের বিনিয়োগ।
অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ‘নারীর ক্ষমতায়ন’কে এসব সূচকের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য স্থানে রেখেছেন। তৈরি পোশাক খাত অত্যন্ত শ্রম-নিবিড় এবং দেশটির শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। চীনের পরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। গার্মেন্টস রপ্তানি তার উৎপাদন জিডিপির প্রায় ৪৫% এবং মোট জিডিপির ৭ %। সাড়ে ৪ হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় ৪০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করছে যার ৮০% নারী। এটি বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে ৮৪% অবদান রাখে, এইভাবে এ খাত বাংলাদেশের বৈশি^ক প্রবণতা এবং অর্থনীতির পরিবর্তনের পথকে উন্মুক্ত করে। বছরের পর বছর ধরে শিশু শ্রমিকের বিস্তার, স্বল্প বেতনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, এবং ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিপর্যয়কর রানা প্লাজার পতনে ১২শ শ্রমিকের মৃত্যু ও আড়াই হাজার আহত হওয়ার মত অনেক ঝড় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। সরকারের সম্পূর্ণ সমর্থন নিয়ে বড় পোশাক প্রস্তুতকারীদের প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা রপ্তানিতে অসামান্য অগ্রগতিতে অবদান রাখে, এই নেতিবাচক বাধা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট রুবানা হকের নেতৃত্ব পোশাক রপ্তানি খাতে এধরনের ঘাটতি পূরণ করছে। তিনি নিয়মিত আইএলও এবং ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ এমপ্লয়ার্সের ভার্চুয়াল ইভেন্টগুলিতে অংশ নিচ্ছেন এবং পোশাক খাতে নতুন নতুন অর্জন বিশে^র সামনে তুলে ধরছেন।
সরকার জনশক্তি রপ্তানিতেও বেশ সক্রিয় ছিল, এর ফলস্বরূপ দশ কোটি প্রবাসী ও অভিবাসী শ্রমিকরা এক বিরাট পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করে। এটি গত দশকে ৮০% বেড়েছে এবং অর্থনীতিতে একটি বড় অবদান রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স প্রাপ্ত দেশ বাংলাদেশ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের বিপদটিও উত্তরণে সরকার এবং ব্যাংকগুলো অভিবাসীদের নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে যাতে তারা সরকারি ব্যাংকিং চ্যানেলগুলির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলগুলো মাধ্যমে দেশে রেমিটেন্স পাঠাতে পারে।
বাংলাদেশের অগ্রগতিতে কৃষিরও সর্বাধিক গুরুত্ব রয়েছে, গত ১৫ বছরে এ খাত বার্ষিক গড়ে ৩.৫০% বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং খাদ্য সুরক্ষার দিকে এগিয়ে চলেছে। ধান, পাট এবং চা কৃষি অর্থনীতির মূল ভিত্তি। মৎস উৎপাদন প্রতি বছর ৬% এরও বেশি গতিতে বৃদ্ধি প্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে প্যারাডাইম শিফটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, বিশেষত নারীদের মাছে ক্ষুত্র ঋণ যোগান দিয়ে।
বিগত কয়েক বছরে, অনেক বেকার যুবক (বাংলাদেশে, জনসংখ্যার ৪০% ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের মধ্যে) ডিজিটাল অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে স্বচ্ছলতার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে সফল হয়ে উঠছেন। আইসিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রচুর অনলাইন শ্রমকে আকর্ষণ করে, অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মতৎপর হয়ে উঠেছে। গার্মেন্টস শিল্পকে একটি শক্তিশালী ও পরিশ্রমী শ্রমশক্তি সরবরাহ করে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নারীর ক্ষমতায়ন এক গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চীনারাও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে যেতে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে যা ভারতকে মনঃক্ষুণœ করছে। নয়টি প্রয়োজনীয় প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের চুক্তি করেছে। আগামী দুই দশকে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ একটি উচ্চাভিলাষী বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে ৩৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে। বাংলাদেশে এখনও অনেক দেশীয় এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে যার সমাধান করতে পারলে দেশটির মানুষ আরো সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটি ধনী দেশ নয়, তবে আমাদের হৃদয় অনেক বড়’।