অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন?
ড. নজরুল ইসলাম
অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বের অন্যতম সেরা। এটি প্রতিটি নাগরিকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে। অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৬০ লক্ষ, যা ছড়িয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ জুড়ে (আয়তন ৭৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার)। এই সমস্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লোকদের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করা কঠিন। এটি যৌথভাবে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের তিনটি স্তর দ্বারা পরিচালিত হয়Ñ ফেডারেল, রাজ্য এবং স্থানীয়। ২০১৭-১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অস্ট্রেলিয়া স্বাস্থ্যের জন্য ১৮৫ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার বা ব্যক্তি প্রতি প্রায় সাড়ে সাত হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার ব্যয় করেছে। এই ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশ শতাংশ। স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকার অর্থায়ন করেছে। বাকি তৃতীয়াংশের যোগান হয়েছে স্বাস্থ্য বীমা এবং জনগণের পকেট থেকে। অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্যসেবার মূলে আছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা, যার নাম ‘মেডিকেয়ার’। এটি আংশিকভাবে অর্থায়িত হয় সাধারণ আয়করের উপর অতিরিক্ত ২ শতাংশ আয়কর দ্বারা, যা ‘মেডিকেয়ার লেভি’ নামে পরিচিত। সাধারণ ব্যয় থেকে সরকার যে কোনও ঘাটতি পূরণ করে। উচ্চ-আয়ের করদাতাদের ক্ষেত্রে এই লেভি আরও ১ থেকে ১.৫ শতাংশ বেশি হতে পারে। মেডিকেয়ার প্রধানত দুই উপায়ে স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ করে। প্রথমটি হলো ‘হাসপাতাল সেবা’ যা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের বিনামূল্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়।
দ্বিতীয়টি হলো ‘মেডিকেল বেনিফিট স্কিম’ যা হাসপাতালের বাইরের পরিষেবাগুলো সরবরাহ করে। এর মধ্যে রয়েছেÑ সাধারণ চিকিৎসক বা জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) পরিষেবা, বিশেষজ্ঞ পরিষেবা, নির্বাচিত ডায়াগনস্টিক ইমেজিং এবং প্যাথলজি পরিষেবাদি এবং চোখের চেক আপ। সরকার মেডিকেয়ারের অধীনে সরবরাহিত সমস্ত পরিষেবার জন্য ‘স্ট্যান্ডার্ড ফি’ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা মেডিকেয়ার বেনিফিট তফসিলের তালিকাভুক্ত রয়েছে। সাধারণত, মেডিকেয়ার এই ফির ৮৫ শতাংশ অর্থায়ন করে থাকে। বাকি ১৫ শতাংশ রোগীকে দিতে হয়। তবে পরিষেবা সরবরাহকারীরা মেডিকেয়ারের ধার্য করা ফি অনুসরণ করতে বাধ্য নন। তারা ইচ্ছামতো ফি নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে রোগীকে আরও বেশি ফি দিতে হয়। কিছু পরিষেবা সরবরাহকারী অবশ্য মেডিকেয়ার প্রদত্ত স্ট্যান্ডার্ড ফির ৮৫ শতাংশ তেই সন্তুষ্ট থাকেন। তারা সরাসরি মেডিকেয়ার এর কাছে বিল পাঠিয়ে দেন, যাকে ‘বাল্ক বিলিং’ বলা হয়। সেক্ষেত্রে রোগীকে কিছু দিতে হয় না। অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আর একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো ফার্মাসিউটিক্যাল বেনিফিট স্কিম (পিবিএস)। এটি অস্ট্রেলিয়ান সরকারের একটি কার্যক্রম যা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য ব্যবস্থাপত্রের ওষুধগুলোকে ভর্তুকি দেয়। যে দেশগুলোর সাথে অস্ট্রেলিয়ার পারস্পরিক স্বাস্থ্যসেবা চুক্তি রয়েছে, সেই সব দেশের নাগরিকরাও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণকালে এর সুবিধা নিতে পারেন।
এই প্রকল্পের আওতায় প্রতি বছরের শুরুতে সরকার সেই বছরের জন্য ব্যবস্থাপত্রের ওষুধের সর্বোচ্চ মূল্য ধার্য করে দেন। চলতি বছরে সাধারণ রোগীদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য হলো ৪১.৩০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার এবং ছাড় কার্ডধারীদের জন্য ৬.৬০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। যদি ওষুধের দাম নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্য ছাড়িয়ে যায় তবে বাকিটা সরকার দেয়। এছাড়াও, যাদের ওষুধের খরচ বেশি, তাদের জন্য আছে পিবিএস সেফটি নেট এর সুবিধা। বর্তমান সেফটি নেট সীমা হচ্ছে, সাধারণ রোগীদের জন্য ১,৪৯৭.২০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার এবং ছাড় কার্ডধারীদের জন্য ৩১৬.৮০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। যদি ক্যালেন্ডার বছরে ওষুধের মোট খরচ এর বেশি হয়, তবে সেই বছরের শেষ পর্যন্ত, সাধারণ রোগীরা ছাড় কার্ডধারীদের দামে (৬.৬০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার) এবং ছাড় কার্ডধারীরা বিনামূল্যে ওষুধ কিনতে পারেন। পিবিএসের অধীনে কেবলমাত্র সেই ওষুধগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া হয় দেওয়া হয় যা ফার্মাসিউটিক্যাল বেনিফিট তালিকাতে তালিকাভুক্ত। বর্তমানে এই তালিকায় ৫ হাজারের বেশি ওষুধ (ব্র্যান্ড আইটেম) রয়েছে যা মোটামুটি ভাবে সব রোগের চিকিৎসা করতে পারে। এছাড়াও প্রতি বছর এই তালিকায় নতুন নতুন ওষুধ যোগ করা হয়। এই তালিকায় অনেক উচ্চমূল্যের ওষুধও রয়েছে। যেমন, ২০১৭ সালে লিউকেমিয়া চিকিৎসার জন্য একটা ওষুধ এই তালিকাভুক্ত হয়েছিল যার ১২০টি ক্যাপসুলের বাজার মূল্য ১১,৬৭২.২১ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। পিবিএস তালিকাভুক্ত হওয়ায় এই ওষুধ সাধারণ রোগী ৪১.৩০ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে এবং ছাড় কার্ডধারীরা ৬.৬০ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে কিনতে পারেন। অবশ্য সরকারকে এতো বেশি দাম দিতে হয় না। কেননা, কোনো ওষুধ পিবিএস তালিকাভুক্ত করার আগে সরকার প্রস্ততকারক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি আছে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়বহুল, তাই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় হ্রাস করার জন্য অনেকে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা (প্রাইভেট হেলথ ইনসিওরেন্স) নিয়ে থাকে। দুই ধরণের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমা রয়েছে।
প্রথমটি হলো ‘হাসপাতাল স্বাস্থ্য বীমা’ যা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় হ্রাস করে। প্রসঙ্গত, বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ মেডিকেয়ার প্রদান করে। দ্বিতীয়টি হলো ‘সাধারণ চিকিৎসা বীমা’ যা হাসপাতালের বাইরে যে সব চিকিৎসা মেডিকেয়ারের আওতায় আসে না, যেমন ডেন্টাল, অপটিক্যাল এবং ফিজিওথেরাপি, এগুলোর ব্যয় বহন করে। প্রশ্ন হতে পারে, যদি সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া যায় তবে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বীমার কি প্রয়োজন? এর কয়েকটা কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হলো সরকারি হাসপাতালগুলোতে অতিরিক্ত চাপের জন্য চিকিৎসা পেতে দেরি হতে পারে। যেমন রোগীর হাঁটুর ব্যথা। হাঁটু প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালে করতে গেলে বছর খানেক অপেক্ষা করতে হতে পারে, স্বাস্থ্য বীমা থাকলে তা এক সপ্তাহের মধ্যে করা সম্ভব। হাসপাতালে অনেক চিকিৎসক থাকে। সবাই চায় নাম-করা চিকিৎসকের চিকিৎসা পেতে। সরকারি হাসপাতালে কোন চিকিৎসক চিকিৎসা করবে তার নিশ্চয়তা নেই। স্বাস্থ্য বীমা থাকলে রোগী তার পছন্দের চিকিৎসক বেছে নিতে পারে। উল্লেখ্য, স্বাস্থ্য বীমা থাকলেও, যদি কেউ ইচ্ছা করে তবে সে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা পেতে পারে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আরও অনেক দিক রয়েছে যা এখানে তুলে ধরা সম্ভব হলো না। এর মধ্যে রয়েছে- ক্যান্সার স্ক্রিনিং, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ডেন্টাল কেয়ার, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থদের জন্য জিপি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের জন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ার, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে ডায়াবেটিস জনিত পণ্য সরবরাহ এবং আরও অনেক পরিষেবা।
সার্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা যে কোনো দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। আমরা ভাগ্যবান যে অস্ট্রেলিয়ায় এতো ভালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে। এটাই ভরসা, যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হই তবে উন্নত মানের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাবে। মেডিকেয়ার গ্যারান্টি দেয় যে, কোনো অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না।
লেখক : শিক্ষক, কার্টিন ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া