আমার দেশ • প্রথম পাতা • লিড ১
অতিরিক্ত ভাড়ায় দাপটে চলছে অটোরিক্সা-রিক্সা নির্দেশ ঘরে থাকার তবুও ভোগান্তিতে রাজধানীর মানুষ
সুজন কৈরী ও ফাতেমা আহমেদ : করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নাগরিকদের চলাচল ও জনসমাগম সীমিত করতে ‘বিধিনিষেধ’ আরোপ করেছে সরকার। বিধিনিষেধের প্রথমদিন সোমবার অন্যান্য দিনের মতো চিরচেনা অবস্থা না দেখা গেলেও রাজধানীর সড়কে বাস ছাড়া সবই চলাচল করেছে। বিশেষ করে সড়কে সড়কে রিকশার দাপট ছিলো চোখে পড়ার মতো। এছাড়া ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে সড়কে অনেক মানুষের চলাফেরাও ছিলো। তাদের মধ্যে কেউ দৈনন্দিন কাজে, আবার কেউ জীবন-জীবিকার তাগিদে বের হয়েছেন। তবে গণপরিবহনের চাপ কম থাকায় ট্রাফিক সিগন্যালে কাউকে অপেক্ষা করতে হয়নি। এছাড়া বিধিনিষেধের মধ্যেও খাবারসহ নিত্যপণ্যেও দোকান খোলা ছিল এবং কাঁচাবাজারেও মানুষের সমাগম ছিল।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস খোলা থাকায় সকাল থেকে দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসগামী মানুষ। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় রিকশা-সিএনজিতে করে বাড়তি ভাড়া দিয়ে বাধ্য হয়ে গন্তব্যে যেতে হয়েছে তাদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
রাজধানী থেকে দূরপাল্লার কোনও বাস ছাড়েনি এবং ঢাকায় ঢুকতেও দেওয়া হয়নি। এছাড়া কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে কোনও যাত্রীবাহী ট্রেন এবং সদরঘাট থেকে কোনও লঞ্চও ছেড়ে যায়নি। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিছুটা কড়াকড়ি অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে।
সরকারি বিধিনিষেধের প্রধমদিন সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, অনেকেই বাসা থেকে বের হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকের মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি। কোনও কোনও এলাকায় দেখা গেছে চায়ের দোকানের আড্ডাও। আবার ফাঁকা রাজপথ পেয়ে বাবাকে পাশে বসিয়ে রাজধানীর শাহবাগে গাড়ি চালাতে দেখা গেছে ১৩ বছরের এক কিশোরকেও। যদিও বিধিনিষেধের মধ্যেও রাস্তায় বের হওয়ার কোনও উত্তর এবং যৌক্তিক কোনও কারণ বলেনি সে।
সোমবার সকালে রাজধানীর মহাখালী, ফার্মগেট, শনির আখড়া, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ীসহ একাধিক স্থান ঘুরে দেখা যায়, রাস্তায় যাত্রীবাহী বাস নেই। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের বেশ চাপ রয়েছে। ফলে রাজধানীর কোনো কোনো জায়গায় স্বাভাবিক সময়ের মতোই ট্রাফিক সামাল দিতে হয়েছে পুলিশ সদস্যদের। এমনকি কিছু সিগন্যালে ছোটখাটো যানজটও দেখা গেছে।
মালিবাগ মোড়ে কথা হয় দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যের সাথে। তিনি বলেন, ‘সকালে রাস্তায় গাড়ি বেশ কম ছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির চাপও বেড়েছে। এ কারণে আমাদের ট্রাফিক সামাল দিতে হচ্ছে। রাস্তায় যাত্রীবাহী পরিবহন চলছে না। তবে রিকশা, সিএনজি, ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। ফলে তিন দিক থেকে ট্রাফিক সিগন্যাল দিতে হচ্ছে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ চাপ কম।’
রিকশায় চেপে অফিসের পথে যাত্রা করা মরিয়ম বলেন, ‘মতিঝিলে অফিস। লকডাউন দিলেও অফিস খোলা রয়েছে। সুতরাং অফিসে যেতেই হবে। গাড়ি বন্ধ থাকায় বাড়তি খরচ করে বাধ্য হয়ে রিকশায় যাচ্ছি।’
অফিসে যাওয়ার জন্য রামপুরার একটি স্থানে বেশ কয়েকজনকে জড়ো হতে দেখা যায়। তারা প্রত্যেকেই একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। রাসেল নামের একজন বলেন, ‘আমাদের অফিস খোলা। কোম্পানির গাড়ির এসে নিয়ে যাওয়ার কথা। এ কারণে গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।’
মালিবাগের আবুল হোটেল মোড়ে কথা হয় ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হওয়া আশফাক আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অফিস খোলা থাকলে বাসা থেকে বের হতেই হবে। সবার পরিবার আছে। রুটি-রুজির চিন্তা আছে। সুতরাং অফিস খোলা থাকলে করোনার ভয়ে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই।’
মোটরসাইকেল নিয়ে বের হওয়া শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় শাহবাগ মোড়ে। তিনি বলেন, ‘লকডাউন হলে কি! অফিস তো বন্ধ নেই। আগের মতোই অফিসে যাচ্ছি।’
দেখা যায় বাস না পেয়ে অফিসগামীরা ভ্যানে চড়ে বসেছেন। কথা হয় ভ্যানযাত্রী সোহাগের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে সাত দিনের লকডাউন দিলেও আমাদের অফিস তো খোলা। আর অফিসে যাওয়ার জন্য কোনো বাস পাচ্ছি না।
মহাখালী বাস টার্মিনালের শ্রমিক ইউনিয়নের জয়েন্ট সেক্রেটারি মানিক মিয়া বলেন, আজকে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকার বাইরে কোনো বাস যায়নি এবং যাবেও না। সরকারি নির্দেশনা যতদিন থাকবে আমরা ততদিন বাস চালাবো না।
গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকেও কোনও বাস ছাড়েনি। অধিকাংশ কাউন্টার বন্ধ। তবে কয়েকটি কাউন্টার খোলা দেখা গেলেও তারা সেগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন। পূর্বাশা পরিবহনের কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা নাইমুল ইসলাম বলেন, কোনও বাস ছাড়ার সুযোগ নেই। কেউ বাস নিয়ে যাত্রা দিলে মামলা-জরিমানা দিচ্ছে পুলিশ। তবে সেলফী পরিবহন নামের একটি বাস যাত্রী নিয়ে গাবতলীতে প্রবেশ করা মাত্রই কর্তব্যরত পুলিশ গাড়িটি আটকে দেয়। যাত্রী পরিবহনের দায়ে ওই বাসকে তিন হাজার টাকার মামলা দেয়।
কর্তব্যরত পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মাহবুব বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তৎপর রয়েছি। এ নির্দেশনায় জরুরি সেবা ছাড়া যাত্রীবাহী সব পরিবহন ও গাড়ি বন্ধ রয়েছে। তারপরও কিছু কিছু পরিবহন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করছে এবং গাবতলী থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। যারাই নির্দেশনা না মেনে গাড়ি বের করছে, তাদের মামলা দিচ্ছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যা যা করা দরকার, আমরা সবই করছি।
সায়দাবাদ টার্মিনাল থেকেও কোনও দূরপাল্লার কোনও বাস ছেড়ে যায়নি। কাউন্টারগুলো ছিল বন্ধ। হানিফ কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা ইকবাল উদ্দিন বলেন, সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সে জন্য কোনও বাস ছাড়া হচ্ছে না। তবে যাত্রীরা এসে টিকিট চাচ্ছেন।
এছাড়া মহাখালী থেকে ফার্মগেট, গুলিস্তানসহ কোনো রুটেই বাস চলেনি। তবে রাস্তায় সিএনজি ও মোটরসাইকেল ছিল। বিভিন্ন রুটে সিএনজি চলতে দেখা গেছে সিট ভিত্তিক ভাড়াতেও।
গণপরিবহন না পেয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবরোধ করেছেন অফিস ও কর্মস্থলগামী মানুষ। এতে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। সোমবার সকাল ৯টার দিকে তারা সড়কে অবস্থান নিয়ে অবরোধ শুরু করেন। পরে পুলিশ এসে অবরোধকারীদের সরিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে।
অবরোধকারীরা বলেন, সড়কে প্রায় সব ধরনের যানবাহনই চলাচল করছে। একজন অবরোধকারী বলেন, ‘কারখানা খোলা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পৌঁছাতে বলা হয়েছে। কিন্তু রাস্তায় এসে দেখি যাওয়ার জন্য বাস নেই। যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তারা ঠিকই অফিসে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যেতে পারছি না। এক জায়গায় দুই অবস্থা, এটা হতে পারে না। হয় সবার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, না হয় সব কিছু বন্ধ করতে হবে।’
যাত্রাবাড়ি, কমলাপুর, বাসাবো, মালিবাগ, বাড্ডা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কর্মস্থলগামী মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেও গণপরিবহন নেই। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কর্মীদের নেয়ার ব্যবস্থা করলেও অধিকাংশ মানুষকেই রাস্তায় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। এ সময় অনেককে রিকশা, সিএনজি, ছোট পিকাপে করেও গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, মানিক মিয়া এভিনিউসহ বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়েনি। অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে চলছে লকডাউন। যে যার মতো পারছে বাসা থেকে বের হচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে লকডাউন কতটা সফল হবে সেই প্রশ্ন অনেকের।
এদিকে অকারণে ঘোরোঘুরি, মাস্ক না পরা, মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনের অপরাধে ২৫ জনকে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার দুপুর ১২ টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত র্যাব-৩ এর সহায়তায় রাজধানীর শাহবাগে এই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।
জরিমানা ছাড়াও প্রায় ২ হাজার ৫০০ জনকে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ করেছে র্যাব।
ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, রিকশাচালক, ভ্যান চালক, মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী যারাই মাস্ক পরছেন না তাদের সচেতন করে মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরিমানাও করা হয়েছে। তিনি বলেন, যারা বিনা কারণে বাইরে ঘোরাঘুরি করছে তাদের সচেতন করা হচ্ছে যাতে তারা বাইরে না আসেন। জরিমানা করা র্যাবের উদ্দেশ্য নয়। করোনা প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য।
সবুজবাগ থানার ওসি মুরাদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা মাইকিং ও টহল পার্টির মাধ্যমে মানুষকে নিয়ম মেনে চলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। অনেক জায়গায় নিয়ম মানা হচ্ছে না। তবে প্রয়োজনে আমরা শক্ত ব্যবস্থা নেব। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও