কালবৈশাখী ও হিট ওয়েভে ইতিহাসে প্রথমবার ব্যাপক এলাকাজুড়ে ধানের ক্ষতি
মতিনুজ্জামান মিটু : হাওড়ের অপেক্ষাকৃত উচু জমির বিআর ২৯ ও হাইব্রিড ধান গাছের শীষ বের হয়ে পরাগায়ণের অপেক্ষায়। এ পর্যায়ে রোববার সন্ধ্যায় আচমকা ঝড়ের সঙ্গে প্রচ- গরম বাতাসে নিমিষেই ক্ষেতের বোরো ধানের শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে যায়। দেশের ২৯টি জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উচ্চতাপমাত্রার বাতাসের ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নেত্রোকোণার মদন, কেন্দুয়া ও খালিয়াজুড়িসহ হাওড় এলাকা। এর সঙ্গে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও ভোলাসহ ২৪টি জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১২ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে।
আমাদের অর্থনীতির ঈশ্বরগঞ্জ প্রতিবেদক জানান, গরম বাতাসের প্রভাবে উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ৫শ হেক্টর বোর ধানের শীষ শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। এতে ৩শ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উপজেলা কৃষি অফিস মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে জানিয়েছে।
উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের হারুয়া গ্রামের চাষি চান মিয়া, জাটিয়া ইউনিয়নের নিজতুলন্দর গ্রামের চাষী আবুল মিয়া, সোহাগী ইউনিয়নের সাহেব নগর গ্রামের চাষী আব্দুর রাশিদ এবং তারুন্দিয়া ইউনিয়নের চরজিতর গ্রামের চাষি ফখর উদ্দিন জানান, ৪ এপ্রিল রোববার বিকেল ৫টার দিকে আকাশের দক্ষিন পশ্চিম কোণে কালো মেঘ জমে হালকা বজ্রবৃষ্টিসহ শুরু হয় ধূলিঝড় ও গরম বাতাসের প্রবাহ। পরদিন সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে চাষিরা দেখতে পান ধানের শীষগুলো শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে। উপজেলার সর্বত্র বোর ফসলের ভয়াবহ ক্ষতিতে শত শত চাষী দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
এদিকে গত মঙ্গলবার এক জুম সভায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, আউশে প্রণোদনা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। বুধবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর প্রমুখ এলাকা কিশোরগঞ্জ ও নেত্রোকোনার বিভিন্ন উপজেলা পরির্শন করেন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, এই বছরের মতো এতো ব্যাপক এলাকাজুড়ে কালবৈশাখীর সঙ্গে হিট ইনজুরি ইতিহাসে আগে আর কখনও দেখা যায়নি। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি থাকায় ধান গাছের ফুল ফোটা অবস্থায় পরাগ শুকিয়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তন জনিতকারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ হতে পারে।
ব্রি’র ফিজিওলোজি বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান, রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিক ইকবাল খান ও কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নজমুল বারী মঙ্গলবার নেত্রোকোণার মদন, কেন্দুয়া ও খালিয়াজুড়ি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত বোরো ধানের ক্ষেত পরিদর্শন করেন।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, চোখের দেখা অনুযায়ী নেত্রোকোণার মদনে শতকরা ২৪ ভাগ, কেন্দুয়ায় ১৬.৫০ শতাংশ ও খালিয়াজুড়ির শতকরা ১৪ ভাগ ধানের ক্ষতি হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের গতিপ্রকৃতি নিবিড়ভাবে দেখছি। এতো ব্যাপক এলাকা নিয়ে এরকমের কাল বৈশাখি আগে দেখিনি। আগাম বন্যার ভয়ে হাওড়ের কৃষকরা অপেক্ষাকৃত নীচু জমিতে আগেভাগে ব্রি ২৮ জাতীয় বোরো ধানের আবাদ করেন। এসব ধান ইতিমধ্যে কাটা শুরু হয়েছে। তবে এ এলাকার কিছু উচু জমিতে বন্যার ভয় না থাকায় পরে ব্রি ২৯ ও হাইব্রিড জাতীয় ধানের আবাদ করা হয়। এসব ধানের গাছে পরাগায়ন হতে পারেনি। উচ্চতাপে এসব ধান গাছের কুশির শীষ ও পাতা থেকে দ্রুত পানি বের হয়ে শুকিয়ে যায়। ধান গাছে ৭ থেকে ১০ দিনে শীষ বের হয়ে ফ্লাওয়ারিং হতে থাকে।
গত রোববারের ঝড়ের সঙ্গে গরম হাওয়া বয়ে যাওয়ার সময় যেসব যেসব শীষে ফ্লাওয়ারিং চলছিলো তার ক্ষতি হয়েছে বেশি। জলন্ত ইট ভাটা থেকে যে ধরনের হিট বের হয় ঐ দিন ধান গাছের উপর দিয়ে সেই ধরনের বাতাস বয়ে যায়। উচ্চ তাপমাত্রার ঐ বাতাস সাপের মতো এদিক থেকে ওদিকে যেয়ে ধানের শীষ জ্বালিয়ে দেয়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের ওয়েভ আরও হতে পারে। পুরো এপ্রিল মাসজুড়ে এ ধরনের গরম বাতাসসহ ঝড় হওয়ার আশংকা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং-এর পরিচালক কৃষিবিদ এ কে এম মনিরুল আলম বলেন, তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম বেশি হলে ধান গাছে সঠিকভাবে পরগায়ণ হয় না। এতে ধানের ফলন কমে যেতে পারে। রোববারে লুহ হাওয়া, ঝড়ের সঙ্গে শিলা বৃষ্টি হয়। এতে ঐসব এলাকার বোরো ধানগাছ সাদা হয়ে যায়। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও