ফলন বাড়ছে, কাঁচা পাটের ভালো সময় যাচ্ছে
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : কৃষি পরিসংখ্যানের তথ্যানুসারে গত ৫ দশকে পাটের ফলন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে এবং মূল্যের দিক থেকে বর্তমানে কাঁচা পাটের ভালো সময় যাচ্ছে। চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ক্রমে কমে যাচ্ছে তবে, সে তুলনায় পাটের চাষ ও উৎপাদন বাড়ছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের বরাতে কৃষিবিদ মো. মুকুল মিয়া জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাটের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো দেশি, তোষা ও কেনাফ-মেস্তার জন্য জমি ০.৩২, ৬.২০, ০.৪৭ লাখ হেক্টর। উৎপাদন ২.৮৪, ৭৩.৩৫, ৩.৮৯ লাখ টন। প্রতি হেক্টরে ফলন ৮.৮৮, ১১.৮৩, ৮.২৮ টন এবং অর্জিত মাত্রা বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে জমি ০.৩২, ৫.৮৬, ০.৪৭ লাখ হেক্টর। উৎপাদন ২.৪৪, ৬২.৪৮, ৩.২৫ লাখ টন। ফলন প্রতি হেক্টরে ৭.৬৪, ১০.৬৬, ৬.৯২ টন। পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের জন্য মোট লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে বিশ্লেষণে ছিলো জমি ৬.৯৯ লাখ হেক্টর, উৎপাদন: ৮০.০৮ লাখ টন এবং ফলন প্রতি হেক্টরে ১১.৪৬ টন আর অর্জিত হিসেবে পাওয়া গেছে জমি ৬.৬৫ লাখ হেক্টর, উৎপাদন: ৬৮.১৮ লাখ টন এবং ফলন হেক্টর প্রতি ১০.২৫ টন। এটা কেবলমাত্র সম্ভব হয়েছে দেশের বুদ্ধিসম্পন্ন ও কর্মঠ কৃষক, মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিরলস প্রচেষ্টার কারণেই।
প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় উচ্চফলনশীল পাটের জাত উদ্ভাবন এবং দেশের পতিত জমিসহ প্রতিটি জায়গায় পাটসহ কৃষি চাষাবাদের লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ভুক্ত বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মেধাবী ও কর্মঠ বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং ইতোমধ্যে ভারত থেকে আমাদানিকরা তোষা পাটের একটি বহিরাগত জাত জেআরও-৫২৪ এবং বিজেআরআই উদ্ভাবিত তোষা পাটের অন্যান্য জাতের চেয়ে অধিক ফলনশীল একটি তোষা পাটের জাত বিজেআরআই তোষা পাট ৮ (রবি-১) গত ২০১৮ সালে উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। যা গত বছর (২০১৯) কৃষক মাঠে বেশ ভালো সাড়া পেয়েছে। কৃষি মন্ত্রীর নেতৃত্বে ও বিচক্ষণ ব্যস্থাপনায় সম্প্রতি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয় যৌথভাবে পাট বীজ উৎপাদন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন যা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের বরাতে, বর্তমানে বাংলাদেশ পাট উৎপাদন ও রপ্তানীতে বিশ্বে প্রথম স্থান দখল করেছে। এছাড়া, কাঁচা পাট রপ্তানিতে দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশ শীর্ষ স্থানে রয়েছে। তারপরেও বিশ্ব বাজারে অতি দ্রুত বর্ধনশীল পরিবেশবান্ধব পাটপণ্যের চাহিদার পাশাপাশি রপ্তানিতেও যাতে শীর্ষ স্থান দখল করতে পারে সে জন্য মূল্য সংযোজিত প্রক্রিয়াজাতকরা পাটপণ্য তৈরিসহ রপ্তানিতে আরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আজ সময় এসেছে পাট ও পাটপণ্যের বহুমুখী ব্যবহার বাড়িয়ে তার এই লালিত স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দান করার; পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে বিজেআরআই নিরলসভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাটের কৃষি বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়নে উৎকর্ষতা অর্জনই হলো বিজেআরআই এর ভিশন। আর পাট ও পাটজাতীয় আঁশ ফসলের উচ্চফলনশীল জাত এবং টেকসই চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, উন্নয়ন, হস্তান্তরের মাধ্যমে কৃষক ও সংশ্লিষ্ট উপকারভোগীদের উপার্জন বাড়ানো, দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের উন্নয়ন করা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য।
এ পর্যন্ত বিজেআরআই সব বিভাগের সহযোগিতায় প্রজনন বিভাগের মাধ্যমে দেশি, তোষা পাট, কেনাফ ও মেস্তা ফসলের মোট ৫২টি জাত উদ্ভাবন করেছে। দেশি পাটের ৩টি শাকের জাত রয়েছে যা অনেক পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং বহুল ব্যবহৃত। এছাড়া, দেশি পাটের একটি জাত জাতীয় বীজ বোর্ডের ছাড়করণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যা প্রায় ১২.০ ডিএস/মি. মাত্রার লবণ সহ্য করতে পারবে, খুব শীঘ্রই তা দক্ষিণাঞ্চলে চাষের জন্য অবমুক্ত করা হবে। পাশাপাশি লবণ, জলাবদ্ধতা ও খরা সহিষ্ণু তোষা পাটের জাতও উদ্ভাবনের ব্যাপক চেষ্টা চলমান রয়েছে। পাটের সোনালী আঁশ ও রূপালী কাঠি দুইএরই রয়েছে অপার সম্ভাবনা। পাটের আঁশ বিভিন্ন পণ্য যেমন পোশাক, জিওটেক্সটাইল, বস্তা, রশি, কাগজ তৈরির পাল্প, বিভিন্ন সৌখিন জিনিসপত্র ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। পাটকাঠিরও রয়েছে অনেক ব্যবহার যেমন, পাটকাঠি পুড়িয়ে তৈরিকৃত কার্বন বা চারকোল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয়। এই চারকোল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন চায়না, ব্রাজিল, তাইওয়ান ইত্যাদিতে রপ্তানি হয় এবং সেখানে এর সাথে লেবুর রস বা ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটারের প্রিন্টারের কালি, ফটোকপিয়ারের কালি, কসমেটিক্সের উপাদান সামগ্রী তৈরি করে যা অনেক চড়া দামে আমদানি করা হয়। যদি দেশে এ প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা যায় তাহলে পাটকাঠির চারকোল থেকে এই মূল্যবান কালি উৎপাদনের মাধ্যমে অনেক লাভবান হওয়া সম্ভব। এ ছাড়াও, পাটকাঠি দিয়ে ঘরের বেড়া দেওয়া যায়, বিদেশে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উন্নতমানের গাড়ির ডেস্কবোর্ড তৈরি করা হয়। যা একেবারে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও