দেশে প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার কাঁঠাল অপচয়
মতিনুজ্জামান মিটু : অন্যদিকে তার প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাবও পূরণ হয়, যা আমাদের দেশের অনেক মায়েদের জন্য খুবই দরকার। গবেষণা ফলাফলের বরাতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পোস্টহারভেস্ট টেকনোলোজি বিভাগের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠাল থেকে ৪৮ কিলোক্যালরি, কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, শরীরের দরকারি শক্তির যোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। আবার অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবন্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন।
কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। পুষ্টিগুণে ভরপুর কাঁঠাল ফলের মধ্যে গুনের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। এতে আছে বেশি পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন যা মানবদেহের জন্য বিশেষ দরকার। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে ১.৮ গ্রাম, কাঁচা কাঁঠালে ২০৬ গ্রাম ও কাঁঠালের বীজে ৬.৬ গ্রাম আমিষ পাওয়া যায়। কাঁচা কাঁঠাল রোগ ব্যাধি উপশমে যেমন কার্যকর, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় অনেকগুন। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান যা হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কাঁঠালে আছে শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। এ ফলে রয়েছে আয়রন যা দেহের রক্তাল্পতা ও এটি আঁশালো হওয়ায় কোষ্ঠকাঠিণ্যও দূর করে। পাকা কাঁঠালে আয়রনের পরিমাণ ০.৫ মি.গ্রা., কাঁচা কাঁঠালে ১.৭ মি.গ্রা. এবং বীজে ১.৫ মিলি.গ্রাম। কাঁঠালের অন্যতম উপযোগিতা হলো ভিটামিন ‘সি’। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন ‘সি’ তৈরি হয় না। ভিটামিন ‘সি’ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে। এতে আরও আছে ভিটামিন ‘বি৬’ যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
দেশের প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামে উল্লেখযোগ্য পরিমান ও উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়। এসব অঞ্চলের কাঁঠাল ভরা মৌসুমে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই রাস্তাঘাটে, ভ্যানে-রিক্সায়, অটোরিক্সা, টেম্পু, ট্রাক ও রাস্তার মোড়ে ও বাজারে ক্ষুদ্র চাষি, ব্যবসায়ী, আড়ৎদার, বেপারী ও পাইকারী বিক্রেতাদের স্তুপ করে বিক্রয় করতে দেখা যায়। এ চিত্রটি প্রায় প্রতিবছরই একইরকম ও দাম খুব কম হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হৃদয়ে কাঁঠাল চাষি ও উদ্যোক্তাদের বিক্রয় করতে দেখা যায় বা বিক্রয় করতে একরকম বাধ্য হয়ে থাকেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশে কাঁঠালের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমান প্রায় ২৫ থেকে ৪৫ ভাগ বা কখনও কখনও এ অপচয়ের পরিমান অনেক বেশী হয়ে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশে প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সমপরিমান কাঁঠালের অপচয় হয়ে থাকে। কৃষক তার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে অনেক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) এর অর্থায়নে পরিচালিত পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) ও নিউভিশন সল্যুশন লিমিটেড, ঢাকার যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণা জরিপেও চিত্রটি ফুটে উঠেছে। এখানে আরও লক্ষ্যণীয় যে, কৃষক সময়মত বিক্রয় করতে না পারা ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে কাঁঠাল গাছ বা কাঁঠালের বাগান কেটে ফেলছেন ও এর পরিবর্তে অন্য ফসল বিশেষত উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন, এটা ঘটলে তা হবে খুবই দুঃখজনক।
পাকা কাঁঠাল খাওয়ার প্রবণতা দেশে খুব বেশি। কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাকতে শুরু করে তখন একসঙ্গে বেশি ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ফলে সেই সময় গাছ হতে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিক ভাবে পড়ে যায় যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না, অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে থাকে। সে সময় অনেকের মতে, গরু বা পশু পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। কিন্তু কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হলে এবং পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকরা খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলে পাওয়া যাবে। অনেক দেশেই গবেষণা মাধ্যমে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সঠিক ব্যবহার করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান বছরব্যাপী কাঁঠালের তৈরি খাদ্য সামগ্রীকে জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করেছে। এতে কৃষক, উদ্যোক্তা ও ভোক্তা সবাই লাভবান হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর অনেক দেশেই কৃষক, উদ্যোক্তা ও বিশেষ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাঝে শক্তিশালী একটি লিংকেজ বিদ্যমান থাকে যেখানে স্টেকহোল্ডার বা প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তির প্রয়োজনে উদ্ভাবনে সহায়তার জন্য সরকারের দিকে চেয়ে না থেকে বরং তারা নিজেরাই প্রকল্প হিসেবে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থ ব্যয় করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দেশে কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে তেমন কোনো অর্থ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ব্যয় করতে উৎসাহীবোধ করেন না বা বাধ্যতামূলকভাবে করার কোন বিধান বা নীতিও নেই বললেই চলে। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ হতে উৎপাদন যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সরাসরি কিনতে অর্থ ব্যয় করে থাকে। এমনকি নিজ অর্থ ব্যয় করে বিদেশ হতে বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত আনা হয়। এতে দেশের অর্থ যেমন বিদেশে চলে যাচ্ছে তেমনি আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকেও সঠিকভাবে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না। সম্পাদনা : ভিক্টর রোজারিও