আমরা কতটা মানবিক?
সংবাদমাধ্যম থেকে প্রতিনিয়তই পেতে হচ্ছে নানা ধরনের অমানবিক সংবাদ। কখনো নির্মমভাবে পিটিয়ে বা পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে শিশু হত্যা কখনো বা চার বছরের শিশুকে ধর্ষণ কখনো বা ছয় বছরের শিশুকে বলদকারের ঘটনা আবার কখনো বা বখাটেদের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করায় এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা নয়তো বা কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করার খবর। আর যখনো এধরনের খবরগুলি শুনতে হয় তখনোই মনে হয়, আমরা বোধ হয় সভ্য জগৎ থেকে আজো অনেক দূরে। সভ্যতার আলো বোধ হয় আমাদেরকে স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আজ আমি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার নবম শ্রেণির ছাত্রী রহিমা আক্তার সোনিয়া কথা বলব না, যে নাকি ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। জান্নাতুল আক্তারের কথা বললেই বা কি লাভ? ময়মনসিংহের কেন্দুয়ার কলেজ ছাত্রী জান্নাতুল আক্তার, যাকে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণে সিলেটের খাদিজার মতোই চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেছে ইমন নামে এক বখাটে। সামাজিক চাপ থেকে রক্ষার জন্য ইতোমধ্যে পুলিশ জান্নাতুল আক্তারের ঘাতক ইমরানকে গ্রেফতার করেছে। তেঁতুলিয়ার সোনিয়ার আত্মহত্যা জন্য দোষীদের সামাজিক নানা চাপের মুখে পুলিশ গ্রেফতার করলেও আসামীদের রক্ষায় নাকি আদা-জল খেয়ে নেমেছেন খোদ তেঁতুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আজ যে দুটি সংবাদ আমার মতো হয়তো আরও অনেকের বিবেককে বিশেষভাবে যন্ত্রনা দিয়েছে তা হলো পারভীন আক্তারের সন্তান প্রসবের ঘটনা অন্যটি রাসিদা বেগমের নিজ পুত্রসন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা। হাসপাতাল চত্বরে পারভীন আক্তারের প্রসব বেদনায় চিৎকারে আয়া নার্স বা ডাক্তার কারোই মন গলেনি। অবশেষে পারভীনের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন আরেক মা তার সঙ্গে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন হাসপাতাল চত্বরে উপস্থিত অনেকেই। তাদের সহযোগিতায় ভূমিষ্ঠ হয় নবজাতক। পারভীন বেঁচে গেলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নবজাতককে। এমন মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৭ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বা আজিমপুর ম্যাটারনিটি কমপ্লেক্সের চত্বরে। যে হাসপাতালটির উদ্দেশ্যই প্রসূতিদের সেবা দেওয়া, এর চত্বরেই ঘটলো এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য। পনেরশত টাকা ঘুষ না দিতে পারায় পুরোপুরি চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন পারভীন আক্তার। মা ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের বিশেষায়িত হাসপাতাল রাজধানীর আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী মেটার্নিটি ক্লিনিক হিসেবে পরিচিত। হাসপাতালটিতে নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদানের কথা থাকলে ও গরীব অসহায় পারভীনের ক্ষেতে তা ভুল বলেই প্রমাণিত হয়েছে। টাকা দিতে না পারায় শুধু আজিমপুর ম্যাটারনিটি নয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ফেরত আসতে হয়েছে পারভীন আক্তারকে। চিকিৎসকেরা নাকি মানব সেবায় নিজেদের উসর্গ করেন, নার্স অর্থাৎ সেবিকারা ও নাকি নার্স ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর আদর্শে অনুপ্রাণিত। অথচ আজ আমাদের দেশে অর্থের কাছে সব আদর্শ সকল অনুপ্রেরণাই যেন অর্থহীন। যদিও আমাদের হাইকোর্ট পারভিনকে চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দোষীদের বিরুদ্ধে কেন আগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না কেন পারভিনকে উপযুক্ত ক্ষতিপুরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছেন ।
এবার আসি ত্রিশ বছর বয়সী রাসিদা বেগমের কথায়। গাজীপুরের পুবাইল বড় কয়ের গ্রামের আবদুস সালামের মেয়ে রাসিদা। প্রায় আট বছর আগে স্বামী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। একমাত্র শিশুসন্তান রাসেলকে নিয়ে টঙ্গীর মরকুন পশ্চিমপাড়া টিটু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। দুই মাস ধরে কোনো কাজ না থাকায় সংসারের অভাব-অনটনের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন রাসিদা। বেশ কয়েকদিন ধরে নিজের ও সন্তানের জন্য খাবার জোগাড় করতে না পেরে অনাহারে নয় বছর বয়সী শিশুসন্তান রাসেলকে নিয়ে রাত্রি যাপন করছিলেন রাসিদা । সন্তান যাতে ক্ষুধার তারনায় খাবারের জন্য তাকে বিরক্ত না করে সেই জন্য ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে রাখেন। পরে ২০ অক্টোবর ২০১৭ ভোরে ঘুমন্ত শিশু রাসেলের গলায় দড়ি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন রাসিদা। সন্তানকে হত্যা করে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়াদের ডাকাডাকি করে সবাইকে তিনি জানান, নিজেই তার ছেলেকে হত্যা করেছেন। পরে পুলিশ এসে রাসিদাকে গ্রেফতার করে। আজ যেখানে আমাদের সরকারের দাবী দেশখাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ মধ্যম আয়ের দেশের পরিণত হতে চলছি আমরা। সেদেশে ক্ষুধা নিবারণ না করতে পেরে একজন মা তার সন্তানকে হত্যা করবে বা কোনো মা তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে বিক্রি করে দিবে, এটা কোনো সভ্য সমাজেরই কাম্য নয়।
স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের প্রশ্ন একজন নাগরিকের সংবিধান মাফিক মৌলিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য বা পুরণের জন্য সরকার কতটুকু আন্তরিক? আমাদের সংবিধান পারভীনকে দিয়েছিল তার চিকিৎসার অধিকার। আমাদের সংবিধান রাসিদাকে দিয়েছিল তিন বেলা তিন মুঠো খাবারের অধিকার। আমাদের সংবিধান সোনিয়াকে দিয়েছিল তার ইজ্জত ও সম্মানবোধ নিয়ে বাঁচার অধিকার। কিন্তু আমাদের সরকারে যারা, আমাদের সংবিধানের রক্ষকগণ কি পারভীন, রাসিদা ও সোনিয়াদের সেই অধিকার টুকু রক্ষা করতে পেরেছে?
লেখক : কলামিস্ট
সম্পাদনা : আশিক রহমান ও মোহাম্মদ আবদুল অদুদ