জল শুকনো ছিল, শরীর ভেজেনি
কোনো কিছুই মিলছে না। বাসায় পানির বিল জমে যাচ্ছে। যে কোনো সময় বিচ্ছিন্ন হতে পারে সংযোগ। সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তায় হাঁটু পানি। মলমূত্র আবর্জনা ভাসে। রিকসা পেতে দেরি হয়। ভাড়াটাও গুণতে হয় বেশি। রোজ দেখা শিশুটি, বয়স বাড়ছে, বড় হচ্ছে, শান্ত-শোভন হচ্ছে না। শহরটাও অস্থির। এক সময় রাতবিরাতে বাসায় ফিরতে অসুবিধা হতো না। এখন নানা উৎপাত। চোর ছিনতাই শত্রু। যে পুুলিশের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সামনে এসে সন্দেহের চোখে তাকায়। বিদ্রুপ করে। যে কোনো নাগরিকই তার কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। দূরে দাঁড়িয়ে সেপাইকে দিয়ে ডেকে পাঠায়। কাছে গেলে ভ্রু তুলে এমন ভঙ্গিমায় কথা বলে, যেন এই শহরের বড় কর্তা তিনি। তার হাতেই রক্ষা কবচ!
সেই একই অন্ধকারে এখনো রাজনীতি। নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। ঘোলাটে হচ্ছে পরিবেশ। উত্তাপ বাড়ছে। আলো দেখছি না। সম্বর্ধনা হচ্ছে। স্লোগান চলছে। শহরের ওপর চাপ বাড়ছে। সংলাপে পাল্টাপাল্টা অবস্থান। একপক্ষ সেনা বা ইভিএম চাইলে, অন্যপক্ষের ‘না’ স্পষ্ট। খোলাসা করে কথা বলে না কেউ। শান্তিপ্রিয় মানুষের উদ্ব্যেগ বাড়ে। রাতে গলিতে হুটহাট সিভিলে পুলিশ নামে। কেউ একজন চেনা হয়ে যায়। না চেনার ভান করে। সতর্ক করে বলে, বাসায় যান। ফেরার এক বা আধাঘণ্টা আগেই ঘরে ফেরে সবাই। দু’মাস তো হতে চললো। এখনো বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা আসছে। প্রাণের ভয়ে পালাতে গিয়ে ডুবে মরছে নাফ নদীতে। লালচোখ মিয়ানমার কিছুই মানছে না। জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক গুড়িয়ে দিচ্ছে বসতি, জমি, ফসল। মানুষ মারছে। জমি-ঘর পুড়ছে। খড়ের মতো পুড়ে মরছে মানুষ। ধর্ষিতা হচ্ছে নারী। ফেরা ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় পুতে রাখছে মাইন। নাগরিকত্বের নামে জটিলতা বাড়ছে। একদিকে ফিরিয়ে নিতে আলোচনা চলছে। দ্বিপাক্ষিক-বহুপাক্ষিক। অন্যদিকে, নির্যাতন অব্যাহত। এখনো রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশ সীমান্তে। মিয়ানমারকে আস্থায় নিতে পারছে না কেউ। জটিল আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক রাজনীতি। কতদিন চাপ বইবে সীমিত সামর্থের বাংলাদেশে। ভাবনা বাড়ছে। কষ্ট বাড়ছে আশ্রিতদের। সজল চোখে রোহিঙ্গারা তাকিয়ে আছে নিজ ভূমির দিকে, স্বদেশে ফেরার আশায়।
যাপিত জীবনে কত অনুষঙ্গ। নতুন যুগ হচ্ছে। পুরনোগুলোও ছাড়ছে না। অফিসের ভর্তুকি কমছে না। আলোচনা হচ্ছে। মিটিং চলছে। বিজ্ঞাপন আসছে না। বাড়ি থেকে ফোন আসছে। ছোট ভাইটার পদোন্নতি চাই। হচ্ছে না। বাড়ির দেয়ালটা বদলাতে হবে। যে জায়গায় ঘর তুলবার কথা, সেখানে এখন পুঁইশাক, পেঁপে গাছ। ইদুর বেড়াল খেলছে। কেবলই পেছোচ্ছে স্বপ্ন। নিজের ঘর হচ্ছে না। যে ছেলেটা সাংবাদিক হতে এসেছিল, এখন তাকে চাকরি করতে হচ্ছে। রোজ চা-পান পান করতে, গাড়ি-ঘোড়ার শব্দের সঙ্গে, বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে আক্ষেপ। উইপোকা খাচ্ছে স্ব^প্ন।
এই যে কাল বৃষ্টি হলো, অঝর বৃষ্টি, আমরা ভিজতে পারিনি। জল শুকনো ছিল। শরীর ভেজেনি। বৃষ্টিতে ভিজতে হলে বৃষ্টি হতে হয়। নরম পেজা তুলোর মতো বৃষ্টি। ছেড়া মেঘ, ছেড়া ঘুড়ির মতো বৃষ্টি। ছাদের কার্ণিশ ঘেষে রোজ বৃষ্টিতে ভেজে যে মেয়েটি, ওর চোখ ভেজে না, ও ভেজে না। ও বৃষ্টির সঙ্গে গল্প করে। আত্মসমর্পন করে। আমরা বৃষ্টি হতে পারিনি। ফুল হতে পারিনি। আমরা নিজেদের চিনি না। অচেনা মন-শরীর টেনে বেড়াই মাত্র। আমাকে নয়, ভাবি মোহ লোভ বাসনা নিয়ে। পরস্পরের সঙ্গে মিলবার ও গোত্রভুত হওয়ার নামে আমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি। আমরা দেখছি মাত্র, অনুভব করছি না, স্পর্শ করছি না। আমরা সময় পার করছি, সময় যাপন করছি না। যাপিত জীবনের যে অংশটুকু আলোময়, সে আলো আমার নিজের নয়, ধার করা, সাজানো। আমি যদি প্রকৃতই আমি হতাম, ফুল পাখি মেঘ হতাম- তা হলে তুচ্ছ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকে উড়িয়ে দিয়ে যাপন করতাম ঘাস ফড়িংয়ের জীবন। জোৎস্না জীবন হতো আমাদের।
মাঝে মধ্যেই এমন হয়। যাচিত অযাচিত নানা অনুষঙ্গ উঠে আসে। রাষ্ট্র সরকার রাজনীতি ভর করে। সংসার পাতি। চলতে-ফিরতে, কাজে-বিশ্রামে, তর্কে-বিতর্কে – ভুল-শুদ্ধ, পছন্দ-অপছন্দ উঠে আসে। আমরা রাজনীতির নামে বিভাজন হয়ে যাচ্ছি। দেশ প্রেমকেও মাপছি দলীয় আদর্শ কর্মসূচি দিয়ে।
যে স্বাধীনতার রং এক, সেখানেও রং দেখছি দলের চোখে, মুখস্থ। কে মুক্তিযোদ্ধা, কে মুক্তিযুদ্ধ করেনি, সে নিয়ে তর্ক চলবে। তাই বলে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ কেউ একজন হঠাৎ করেই বিরাগভাজন হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযোদ্ধার নানা ধরণ প্রকৃতি। পরবর্তি স্বদেশ-স্বজাত্যবোধ ও প্রেম, প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চা ও ধারণ, সবকিছু মিলেই একজন মানুষ। মানুষকে অনেক বড় হতে হয়। বড়। সবুজ মাঠের মতো আদিগন্ত, বিস্তীর্ণ।
লেখক : সাংবাদিক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদনা : আশিক রহমান