কৈশোরের প্রেম, বিয়ে এবং পরিণতি
এবিসি রেডিও এর প্রতি রবিবার রাত ১১-২০ মিনিটে প্রচারিত হয় জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ (অপরাধ জীবন এর সত্য কাহিনী)। আমি এ অনুষ্ঠানের নিয়মিত পরামর্শক। এ রবিবারে প্রচারিত কাহিনী সংক্ষেপ : শাহ আলম, বর্তমান বয়স- ৪৪ বছর। সদ্য কারামুক্ত হয়ে চলে আসে রেডিওতে নিজ জীবনের করুণ কাহিনী বলতে। তাদের এলাকার সিনেমা হলের সামনে তাদের একটি দোকান ছিল। একটি মেয়ে প্রায়শই সেখানে যেত, তার সঙ্গে কথা হতো। এভাবে একসময় মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। একদিন সে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। মেয়েটি বলে আমার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলো। শাহ আলম মেয়ের মায়ের কাছে প্রস্তাব দেয়, কিন্তু মা বলে আমার মেয়ে তো ছোট। শাহ আলম বলে আমিও তো ছোট। তখন মেয়ের মা বলে তোমার ফ্যামিলিকে জানাও।
তবে শাহ আলম তা জানায় না। এক সময় তারা বিয়ে করে ফেলে। শাহ আলম দোকানের যা আয়-উপার্জন সব স্ত্রী ও শ্বশুর বাড়ীর পিছনে খরচ করে। এভাবে খরচ করাতে তার দোকানে মালের অভাব পড়ে। বাবা এরকমটি দেখে ক্ষিপ্ত হয়।
তখন পাড়া পরশীরা এলাকার এক খারাপ মহিলার কথা বলে যে হয়তো ওর পিছনে এতো খরচ করেছে। মুরুব্বিরা তাই সিদ্ধান্ত নেয় যে শাহ আলমকে বিয়ে করিয়ে দেওয়া দরকার। তারা বিয়ে ঠিক করে শাহ আলমকে মিথ্যে কথা বলে সেখানে নিয়ে যায়। শাহ আলম বাধা দিতে চাইলে তার বাবা বলে আমি জানি কেন তুমি রাজি হচ্ছো না। বাবা বুঝাতে চেয়েছে ঐ খারাপ মহিলার কথা কিন্তু শাহ আলম ভেবেছে বাবা বোধ হয় তার পূর্বের বিয়ের কথা জেনেছে সেটি বলছে।
বিয়ে হয়ে গেলেও শাহ আলম তা মেনে নেয় না। সে তার প্রেমিকা ও পূর্বে বিবাহিত বউকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে। এরপর সবাই ব্যাপারটি বুঝতে পারে ও ২য় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়ে যায়।
ঢাকায় যে বাড়ীতে শাহ আলমরা ভাড়া থাকত সেই বাড়ীওয়ালা শাহ আলমের সুন্দর চেহারা দেখে, তার কর্ম ও আয় উপার্জন ভালো দেখে তাকে পছন্দ করে ফেলে। বাড়ীওয়ালা তার শালীর সঙ্গে শাহ আলমকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করে। একারণে তাদের দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া-ফ্যাসাদ লাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শাহ আলমকে বলে তোমার বউ ওমুকের সঙ্গে, তমুকের সঙ্গে গল্প করে, সম্পর্ক করে ইত্যাদি। অন্য দিকে তার বউকে বলে তোমার স্বামী এটা করে, ওটা করে ইত্যাদি।
এভাবে তাদের সুখের সংসারে নেমে আসে কলহ, বিবাদ ও সন্দেহ। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। শাহ আলমের সন্দেহ গভীরতর হয়। এক পর্যায়ে সে তার স্ত্রীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা মাফিক সে বউকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি রওয়ানা হয় নাইট কোচে। সে একটি ছুরি কিনে আনে। অনেক রাতে এক নির্জন স্থানে নিয়ে সে তার বউকে হত্যা করে। মারা যাবার আগে তার বউ সব সত্য কথা বলে যায় সে নির্দোষ ছিল, বাড়ীওয়ালার চক্রান্তে শাহ আলম তাকে ভুল বোঝেছে, তাকে মিথ্যে সন্দেহ করেছে।
এরপর শাহ আলমের সম্ভিত ফিরে। সে সরাসরি পুলিশের কাছে গিয়ে নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করে। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯।
অপরাধী হিসেবে জীবনের সুবর্ণ সময়ের ২৫টি বছর তার কেটে যায় অন্ধকার কারাগারে।তরুণ শাহ আলম জেল থেকে বের হয় বোড় বয়সে।
সে জেলখানায় বসেই শুনতো অনুষ্ঠানটি। তাই সে চলে আসে এ অনুষ্ঠানে নিজের ভুল, অহেতুক সন্দেহবশত প্রেমিকা স্ত্রীকে নিজ হাতে হত্যা করার অপরাধ ও করুণ কাহিনী আমাদের জানাতে যাতে ও আর কেউ মিথ্যে সন্দেহ করে এরকম অন্যায়, ভুল আর না করেন সে কথা বলতে।
আমার সংক্ষিপ্ত পর্যবেক্ষণ :
১। কৈশোরে প্রেম ও বিয়ে : বিয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। অল্প বয়সের প্রেমের মোহে পড়ে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে যারা বিয়ে করে ফেলে তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিনাম ভালো হয় না। তবুও বাল্য বিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না। ২। অভিভাবকদের তদারকির অভাব : শাহ আলমের বাবা তার ছেলে কোন পথে দোকানের সব টাকা খরচ করে ফেললো তা নজরদারি করতে পারেননি। ছেলে প্রেম করত তা বোঝতে পারেনি। এমনকি বিয়ে করে সংসার চালাচ্ছে তাও আন্দাজ করতে পারেনি। সন্তানদের প্রতি তদারকি ও নজরদারির এতো ঘাটতি থাকলে তাদের বখে যাওয়া, কুপথে যাওয়া আমরা ঠেকাব কেমনে? ৩। বাড়ীওয়ালা একজন বিবাহিত ছেলের বিয়ে ভেঙে তার সঙ্গে নিজ শালির বিয়ে দেওয়ার কুমতলবে যে ষড়যন্ত্র করেছে এরকম লোভী, পিচাশ ধরনের মানুষ আমাদের সমাজে কম নেই। এদের প্রতারনা সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারনে শাহ আলমের মতন অনেকের জীবন বিষময় হয়ে উঠে। ৪। প্রেম- দাম্পত্যে সন্দেহ : এ ধরনের সন্দেহ-
ক) স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকতে পারে- যে জেলাসি/ঈর্ষা মনোমালিন্য তৈরি করলেও তা আবার মিটিয়ে ফেলা যায়।
খ) এটি আরেকটু মাত্রাতিরিক্ত ও জটিল হতে পারে- যা দাম্পত্য জীবনকে অসুখী করে রাখে।
গ) এটি প্যারানয়েড পারসোনালিটির জন্য হতে পারে- যা দাম্পত্য জীবনকে বিষময় করে তুলে এবং ঘ) এটি ডেলুশনাল ডিসঅর্ডার বা মরবিড জেলাসি হতে পারে- যা শাহ আলমের মতন নৃশংস খুন, নির্যাতন পর্যন্ত গিয়ে ঠেকতে পারে।
এক মাত্র ক নম্বর ছাড়া বাকি ক্ষেত্রগুলোতে মনোচিকিৎসকদের থেকে চিকিৎসা, কাউন্সিলিং নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে সংসার দোজখে রূপান্তরিত হতে পারে এমনকি শাহ আলমের মতন নৃশংস হত্যাকা- ও ঘটতে পারে (মরবিড জেলাসি নিয়ে এক সময় বিস্তারিত লেখার আশা করি)
লেখক : মনোবিদ
সম্পাদনা : আশিক রহমান