‘বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার তত্ত্ব’Ñ বিকৃত রাজনীতির বিকৃত ঔষধ
সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশন বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে গিয়ে তাদের মুখ থেকে সব সময় উচ্চারিত পছন্দের বাক্য ‘জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা’ বলে অভিহিত করায় দেশে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তা সবাই অবগত। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিষয়টিকে ‘বিএনপিকে কাছে টানার’ সিইসির কৌশল হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু অবশ্য রাষ্ট্রীয় পদে বসে ইতিহাস ও রাজনীতি চর্চা না করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে বেশির ভাগ মানুষই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এ বিষয়ে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সিইসির সঙ্গে বসা সংলাপ থেকে বের হয়ে আসেন। লেখালেখিও করছেন। বঙ্গবীরের প্রতিবাদ কিছুটা হলেও মানুষকে আশ্বস্ত করেছে। তবে বোঝা গেল, আওয়ামী লীগ সিইসির এমন বক্তব্য নিয়ে মাঠ গরম করতে চায়নি কৌশলগত কারণেই। তাহলে বিএনপি নতুন ইস্যু নিয়ে মাঠ গরম করার সুযোগ পেয়ে যাবে। এমনিতেই বিএনপির নেতারা সিইসির কথা শুনে যেভাবে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছিলেন তাতে নির্বাচন কমিশন এমনিতেই বেকায়দায় পড়ে যাচ্ছিল, আওয়ামী লীগের ভাষা আক্রমণে সিইসি শেষ পর্যন্ত কুপোকাত হতে বাকি থাকত না। সে দিক থেকে বিচার করলে আওয়ামী লীগকে এমন একটি বিষয়কে হজম করতে হলো যা নিয়ে ভবিষ্যতে ব্যাখ্যা দিতে দিতেই ঘর্মাক্ত হতে হবে। দীর্ঘদিন থেকেই ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে রাজনীতি সচল করা নিয়ে তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে কৃতিত্ব দেওয়ার একটি ধারা চলে আসছে। পাঠ্যপুস্তকেও বিএনপির শাসনামলে তুলে ধরা হয়, বিএনপি ঘরণার বুদ্ধিজীবীরাও কথাটি অনেকটা এভাবেই বলার চেষ্টা করে থাকেন। এর ফলে আমাদের দেশে এরই মধ্যে যেসব তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে, সাধারণ মানুষরা অনেকেই এমনটিই বিশ্বাস করছে। তাদের সম্মুখে এর বিপরীত ব্যাখ্যাটি খুব একটা উপস্থাপিত হয়নি, আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই ব্যাখ্যাটি দিতে গিয়ে ব্যক্তি জিয়াকে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য বলতে গিয়ে মূল প্রসঙ্গই হারিয়ে যায়, দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া যারা বলেন তারা তৎকালীন সামরিক শাসন থেকে উর্দি পরা রাজনীতির শাসনে উত্তরণের চরিত্র তুলে ধরার মতো প্রস্তুতি গ্রহণ না করে যেসব কথা বলেন তা মোটেও যথেষ্ট নয়। ফলে বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের হত্যাকা-, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর-উত্তর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন থেকে জিয়াউর রহমানকে রেখেই আধা সামরিক রাজনীতিতে উত্তরণ ঘটানোর কূটকৌশলটি অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। সামরিক শাসন থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কতটা ভিন্নতা নাকি কৌশল পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোকে খুঁটিতে বেঁধে রাজনীতির নামে একদিকে আধা সামরিক শাসন, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহকে রাজনীতির মাঠে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়ার ছক আটাÑ এ সবই গভীর রাজনীতির প্রকৃত জ্ঞানতত্ত্বীয় বিষয়। সেই জ্ঞানতত্ত্বীয় বিষয়কে আড়াল করতে, দুর্বল করতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা রূপে অভিহিত করার তত্ত্বটি একেবারেই নকল ওষুধের বটিকা ছাড়া আর কিছু নয়। এ ধরনের লাল ইটের গুঁড়ো মিশ্রিত বটিকা তত্ত্ব বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভেজাল হামদর্দ নামধারী ওষুধের মতো সহজলভ্য। কম দামি কিন্তু গভীরভাবে ক্ষত সৃষ্টিকারী। আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে এমন বিকৃত তত্ত্ব বিকোচ্ছেন দেশে জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীরাও। ১৯৭২-৭৫ সালের রাজনীতি নিয়েও সে রকম বস্তা পঁচা তত্ত্ব বিকোনো হচ্ছে, বাকশাল নিয়ে তো এখনো প্রতিদিন অনেক কথা শুনতে হয়। যা শুনে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না, হয় তারা রাজনীতির বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজ্ঞানের ন্যূনতম বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করেনি, নতুবা তারা বিকৃত তত্ত্বের বটিকা সেবন করে নিজেদের মেধা ও মননের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। তারা বাকশালকে এখন ‘রাজনৈতিক গালমন্দ’ রূপেও ব্যবহার করছেন। শুধু দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিদ্বেষমূলকভাবে গালমন্দ করছে না, মুক্তবুদ্ধি চর্চার কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকেও বাকশালী বলে ‘গালমন্দ’ করতে বিবেকের চর্চা করেন না। গেল সপ্তাহে একজন প্রভাবশালী দাম্ভিক বিএনপি নেতা একাত্তর টিভির টকশোতে বসে বলেই বসলেন, একাত্তর টিভি বাকশালী টিভি। একাত্তর টিভিকে হজম করতে হলো। বাংলাদেশে রাজনীতিতে বিকৃত তত্ত্ব চর্চার দীর্ঘদিনের ফসল হচ্ছে এটিই। সিইসি শুধু একা নন, বাংলাদেশে অসংখ্য জ্ঞানী, বিদ্যান, প-িত ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে রাজনীতির মাঠে প্রায় চার দশক চলে আসা নকল তত্ত্বের প্রচারে এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে আছেন তারাও এমনটিই বিশ্বাস করছেন। কারণ তারা রাজনীতির জ্ঞানতত্ত্বীয় ধারণা ব্যতীত মনগড়া বানোয়াট তত্ত্বই শুনে আসছেন। অথচ জিয়াউর রহমানের বিখ্যাত উক্তি সবাই জানেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেব।’ যিনি এমন কথা বলতে পারেন তিনি রাজনীতির কতটা মঙ্গল নাকি ক্ষতি করেছেন তা কি তলিয়ে দেখা উচিত নয়? আমাদের দুর্বল রাজনীতির দেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, আওয়ামী লীগকে কার্যত নিষিদ্ধ সংগঠনের পর্যায়ে ফেলে সব নেতাকর্মীকে জেলে বা দৌঁড়ের উপর রেখে, সংগঠনে ভাঙন ঘটিয়ে ‘রাজনীতি’ করার দাসখত দেওয়ার পরিণতি কত ভয়াবহ হতে পারে তা ভেবে দেখার বিষয়। অন্যদিকে রাজনীতির আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থের ব্যক্তিদের নিয়ে যেভাবে দল গঠন, দেশের রাজনীতিতে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হলোÑ তাতে দেশের রাজনীতিতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হলো। তারা কেউই দেশটার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, প্রগতি, উন্নতির কোনো ধারাতেই সম্পৃক্ত ছিল না, বিরোধিতা করা ছাড়া। এমন চরিত্রহীন রাজনীতিবিদদের দিয়ে সদ্য স্বাধীন কোনো দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির জন্য অবাধ পরিবেশ, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিকে কোণঠাসা করে রাখার যে নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছিলÑ তা দেশটাকে শেষ পর্যন্ত আর্দশহীন, সাম্প্রদায়িক ধারায় বেড়ে উঠতেই করা হয়েছিল। সেটি বাংলাদেশে সফলভাবে করা গেছে, এর ফলে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সুদূর পরাহত হয়ে পড়েছে। নকল রাজনৈতিক তত্ত্ব এখনো ক্রিয়াশীল এবং খুঁজতে নির্ভেজাল, রাজনীতির জ্ঞানতত্ত্বের চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়