রুহ : স্বরূপের সন্ধানে
সৈয়দ রশিদ আলম : মানুষ যখন মানব আকৃতি পায়নি তখন রুহানি জগতে সে অবস্থান করছিল। সে জগৎটা হচ্ছে রুহের জগৎ। হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টির পর তিনি পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে ছিলেন। নড়াচড়ার কোনো ক্ষমতাই ছিল না। কিন্তু পরম করুণাময় যখন আদম (আ.) এর ভিতর তার রুহ্টা ফুকে দিলেন তখন তিনি চোখ মেলে পরম করুণাময়কে দেখলেন। সেই সাথে ফেরেস্তাদের দেখলেন। তার ভিতর যে পবিত্র রুহ্টা ফুতকার করা হয়েছিল সেটা ছিল পবিত্র আতœা। বাইতুল মোকাদ্দাস মসজিদ, মা মরিয়ম (আ.) চুপচাপ বসে আছেন, হঠাৎ করে পুরো মসজিদ চত্তর আলোকিত হয়ে গেল, তিনি দেখতে পেলেন আলোকময় একজন রুহুপ্রাপ্ত ফেরেস্তাকে। সেই ফেরেস্তা তাকে সন্তান হওয়ার সুসংবাদ জানালেন। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু সুসংবাদদাতা রুহ প্রাপ্ত ফেরেস্তা তাকে আশ্বাস দিলেন আপনার ভয় নেই, আপনি পুত্র সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন। এটাই পরম করুনাময়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মা মরিয়ম (আ.) কে রুহ ফুতকার করা হল। তিনি সন্তান ধারণ করলেন, এক পর্যায়ে তিনি পুত্র সন্তানের মা হলেন। এই পুত্র সন্তানটি হচ্ছেন ঈসা (আ.) তার উপাধি ছিল রুহুল্লাহ্। এই উপাধি অনেকেই বুঝতে পেরেছেন, অনেকেই বুঝতে পারেননি। যারা বুঝতে পারেননি তারা ভুল করে ফেলেছিলেন। আর যারা বুঝতে পেরেছিলেন তারা স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছিলেন। তুর পাহাড়, হযরত মুসা (আ.) আলোর সন্ধানে তুর পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে চাইলেন, সেখানে তিনি আলোক রশ্মি দেখতে পেলেন। তিনি সেখান থেকে হেদায়েতের আলো নিয়ে এলেন। পবিত্র নূর ও রুহ্ প্রাপ্ত হয়ে হযরত মুসা (আ.) নিজে আলোকিত হলেন, জগৎকে আলোকিত করলেন। যারা তার ডাকে সাড়া দিলেন, তারা রুহের সন্ধান পেলেন। হেরা পর্বত, মুহাম্মদ (সা.) ধ্যান সাধনা করছেন, হঠাৎ করেই হেরা পর্বত আলোকিত হয়ে গেল, উপস্থিত হলেন রুহুল কুদ্দুস। তিনি মুহাম্মদ (সা.) কে মহান আল্লাহ্র বাণী পৌঁছে দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি মুহাম্মদ (সা.) কে নিজের বুকের সাথে তিনি চেপে ধরলেন। মুহাম্মদ (সা.) এর অন্তকরণ শীতল হয়ে গেল। তিনি রুহুল কুদ্দুস এর রহস্য জেনে গেলেন। নিজে চিরদিনের জন্য মহা পবিত্রতা অর্জন করলেন। এরপর তিনি যাদের কাছেই মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন, তারাই হেদায়েদের আলোয় নিজেদের আলোকিত করতে পেরেছিলেন। আমাদের দেশের এক শ্রেণির পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসীর আর্বিভাব ঘটেছে, এরা রুহের পরিচয় দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। তারা প্রচলিত শরিয়তকে পরিত্যাগ করে সরাসরি মারেফাতের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মারেফাতের শাহেন শাহ্। সৃষ্টির সমস্ত মারেফাত তার অধীন ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন শরীয়ত পালন করার ক্ষেত্রে উজ্জল দৃষ্টান্ত, ছিলেন জীবন্ত কুরআন। শরীয়তকে পরিত্যাগ করে যারা মারেফাতের মাধ্যমে রুহের সন্ধান করবেন, তারা চিরকালের জন্য বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে থাকবেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর এক দল সাহাবী ছিলেন, যাদেরকে আহলে সুফ্ফা বলা হয়। এরা সকাল সন্ধ্যায় সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ভাবতেন। তাদের শিক্ষক ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)। এই সম্মানিত সাহাবীরা ইলমে শরীয়তকে অর্জন করার পরই ইলমে মারেফাত অর্জন করেছিলেন। রুহের পরিচয় জেনে ছিলেন। সকাল সন্ধ্যায় পরম করুণাময়ের কাছে যারা সমর্পিত হতে পেরেছেন, তারাই রুহের পরিচয় লাভ করেছেন। প্রতিটি বৃক্ষ লতা পরম করুণাময়কে সবসময় সেজদাহ্ করছে। মানুষ যখন পুত পবিত্র হয়ে যায়, তখন সে বৃক্ষের মতো পরম করুনাময়ের কাছে নত হওয়ার কৌশল জেনে যায়। জানার পরই সে নিজের ভিতরে বসবাসরত রুহের পরিচয় জেনে যায়। জানার পর সে পরম করুনাময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করার কৌশল জেনে যায়। এরপর যেখান থেকে তার শুরু সেই রুহের জগতে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই প্রস্তুতির সময়টাকে জেহাদ বলা হয়েছে। দুনিয়ার সমস্ত মোহকে পরিত্যাগকারীরা জেহাদের ময়দানে বিজয়ী হয়ে যান। তখন তিনি যেরকম রুহের জগতে পবিত্র ছিলেন দুনিয়াতে থেকেও তিনি সেরকমই পবিত্র হয়ে যান। তারপর তিনি প্রতিক্ষায় থাকেন কখন পরম করুণাময় তাকে ডাকবেন। তিনি আশা করতে থাকেন মহান রাব্বুল আল-আমিন তাকে তার পবিত্র আরশের নীচে স্থায়ীভাবে থাকতে দিবেন। এটাই মুমিনের চূড়ান্ত চাওয়া। এর পর আর কোনো চাওয়ার বিধান রাখা হয়নি। সুফীবাদের শাহেনশাহ্ মহিউদ্দিন ইবনুল আরাবী যথার্থই বলেছেন, শরিয়ত পালনের পর মহান আল্লাহ আমার সামনে মারেফাতের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। তারপর আমি মহান রাব্বুল আলামিনের আরশ পর্যন্ত প্রত্যেক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এরপর আমি চূড়ান্ত পবিত্রতা অর্জন করি ও রুহ্ প্রাপ্তদের অন্তভূক্ত হয়ে যাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ