নতুন অর্থনৈতিক দর্শনের পথে আসিয়ান
অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশন্স (আসিয়ান) এর দশ সদস্য রাষ্ট্রের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা বৈঠক করে নীতিগতভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে এক বাজার ব্যবস্থা চালু করা হবে। নেতারা মালয়েশিয়াতে আসিয়ানের শীর্ষ বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরেন। কোনও সন্দেহ নেই আসিয়ান দেশসমূহের জনগণের জন্য এটা সুসংবাদ। কিন্তু অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন (ইইউ) মতাদর্শে বা ওই কৌশলে চললে আসিয়ান অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইইউ এক মুদ্রানীতি ও এক বাজার ব্যবস্থা চালু করে লাভবান হয়েছে। তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছে।
ইউরোপের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি এবং আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে আসিয়ান দেশের তুলনা করা নিরেট বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইউরোপীয় অর্থনীতিতে যে সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হয়েছে, আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রসমূহ এত দ্রুত পারবে বলে মনে হয় না।এক মুদ্রা ও উম্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বহু মতবিরোধ রয়েছে। নানা রকম মতবিরোধ দূর করতে পারলেই এক বাজার ব্যবস্থা চালু হলে সদস্য রাষ্ট্রের সবাই লাভবান হবে। আসিয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৭ সালের ৭ আগস্ট। প্রাথমিকভাবে এর সদস্য ছিল ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিনস, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডÑ এ পাঁচ রাষ্ট্র। পরবর্তীতে আরও পাঁচ রাষ্ট্র ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার এবং ভিয়েতনাম আসিয়ানের সদস্য পদ লাভ করে।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে আসিয়ান দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য এ সংস্থা গড়ে উঠেছিল। অর্ধ শতাব্দী পার হতে চলেছে আসিয়ানের, কিন্তু সাফল্য কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রসমূহ খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, সেটা সাম্প্রতিক বৈঠকে প্রমাণ মেলে। নেতৃবৃন্দ আসিয়ানের ব্যর্থতার নানা দিকগুলো তুলে ধরেছেন। তারা নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন, সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ভিন্ন ভিন্ন বাজার ব্যবস্থা, সংকোচন মুদ্রানীতি, সদস্য রাষ্ট্রসমূহের এক অপরের দেশে অবাধে পণ্য প্রবেশে নানা রকম সরকারি বিধিনিষেধ, এ সব কারণেই আসিয়ান এ দীর্ঘ ৫০ বছরেও কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। আসিয়ানের ব্যর্থতার অর্থই হচ্ছে এশিয়ার এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কল্যাণ সাধিত হবে না। তারা পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই থেকে যাবে।
আসিয়ানের এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ এবং বিনিয়োগে নানা রকম বাঁধা প্রদান। দশ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের পণ্য অবাধে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাবে, সেবাখাত উন্নত করা, ব্যাপক বিনিয়োগ এবং দক্ষ শ্রম শক্তির প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বিগত দশকে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে আসিয়ান। আসিয়ানের অন্যতম দুই সদস্য রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া সাম্প্রতিক সময়ে কমন টাইম জোন চালু করেছে। সময় নির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে সমস্যা চিহিৃত করে তা দ্রুত সমাধান করছে তারা। বিশেষ করে ব্যাংক এবং পুঁজি বাজারে জড়িত এ দুই দেশের ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে। ব্যবসায়ের প্রসার বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতি গতিশীল হবে। এক মুদ্রানীতি ও পণ্যের অবাধ যাতায়াতে আসিয়ান ইকোনোমিক কম্যুনিটি (এইসি) গঠন করা হয়েছে। এই সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের মধ্যে এক অর্থনৈতিক দর্শন চালু করা। সমস্যা হচ্ছে এ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সিঙ্গাপুরের মত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যেমন রয়েছে তেমনি এক সময়ের স্বৈরশাসক রাষ্ট্র মিয়ানমার পর্যন্ত রয়েছে।
মুক্তবাজার ব্যবস্থা চালু করতে মায়ানমার সরকার কতটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এক মুদ্রানীতি ও সাধারণ বাজার ব্যবস্থা আসিয়ান সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রচলনে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ভাষাগত, মুদ্রার ব্যাপক তারতম্য এবং এক অপরের প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ প্রকটাকার ধারণ করেছে। এসব মৌলিক সমস্যা সমাধান ছাড়া এক মুদ্রানীতি ও একক বাজার ব্যবস্থা চালু হবে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে আসিয়ান পরাশক্তিতে রূপ নিতে পারে। আসিয়ানে মোট জনসংখ্যা ৬২ কোটি, যা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং উত্তর আমেরিকা থেকে বেশি। আসিয়ানের শ্রম শক্তিতে বিশ্বে আসিয়ানের অবস্থান তৃতীয়। এশিয়ার একজন মানুষ হিসাবে এটা বিশ্বাস করি, আসিয়ান একক এবং অবাধ বাজার চালু হলে এ অঞ্চলের মানুষ উন্নত জীবন লাভ করবে। আসিয়ানের অর্থনৈতিক উন্নতি মানেই এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রসার ঘটবে। এইসির সদস্য রাষ্ট্র সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারলে তা হবে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম অর্থনৈতিক সংস্থা, এটা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অবশ্যই জরুরি। এক মুদ্রা ব্যবস্থা এবং অবাধ বাজার চালু করতে হলে সকল প্রকার রাজনৈতিক বিরোধ, সংঘাত, অবিশ্বাস দূর করা প্রয়োজন। এইসি গঠন আসিয়ানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়ন মানেই হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটা এবং নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। আসিয়ানের উন্নতির অর্থই হচ্ছে ব্রাজিল, ভারত এবং রাশিয়ার অর্থনীতিকে টপকে যাবে। আসিয়ানের ৬২ কোটি সহ এশিয়ার ৪১৭ কোটি মানুষ এইসির সাফল্যের দিেেক চেয়ে আছে।
লেখক : উন্নয়ন কর্মী ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
সম্পাদনা : খন্দকার আলমগীর হোসাইন