শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শ্রদ্ধাঞ্জলি, আমাদের চেতনায় ১৪ ডিসেম্বর
নি র্দিষ্ট সংজ্ঞা অন্বেষণ না করেও বলা যায়, বুদ্ধিজীবীরা দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবিত্তিক শ্রম প্রদান করেন বেশি। এই শ্রেণিতে আছেন- লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। এটা সত্য যে, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জনতাকে, জাগ্রত করেন বিবেক, লালন করেন সকল শুভ প্রত্যয়। চিন্তাধারা ও লেখনির দ্বারা কিংবা গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে তারা আস্থার জায়গাটি তৈরি করেন। অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস তারাই দেখাতে পারেন। এজন্য সাধারণ মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবীরা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সামরিক জান্তা কিংবা অত্যাচারী শাসকরা সাধারণ মানুষকে উসকানির অজুহাতে বুদ্ধিজীবীদের হয়রানি করেন; সুযোগ পেলে করুণ পরিণতি ডেকে আনেন। ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে ভুরি ভুরি।
২. বুদ্ধিজীবীদের ওপর সবচেয়ে বড় এবং প্রধান আঘাত আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারি নীতির কারণে। তার দলের নেতৃত্বের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং যুদ্ধের সময় নাজিবাহিনীর হত্যাকা- ছিল মেধা শূন্য করার ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক রাষ্ট্র হিটলারের নাজিবাহিনীর দ্বারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। শহর আর গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ইহুদি হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ করুণ পরিণতির শিকার হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের বুদ্ধিজীবীদের অর্ধেকই হত্যাকা-ের শিকার হন। কোনো কোনো পেশার ২০ থেকে ৫০ ভাগ সদস্য নিশ্চিহ্ন হন। জার্মান নাজিবাহিনীর নির্মমতার শিকার হন ৫৮ শতাংশ আইনজীবী, ৩৮ শতাংশ চিকিৎসক, ২৮ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বুদ্ধিজীবী হত্যার এই সারণি দীর্ঘতর হয় ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ৬০ শতাংশ মানুষ হত্যাকা-ের করুণ পরিণতি লাভ করে। নাজিবাহিনী সেই দেশ দখল করে গণহত্যা চালায়। ১৯৪১ সালে জার্মানরা লেলিনগ্রাদ দখল নিয়ে অবরুদ্ধ করে এবং নির্মম হত্যার শিকার হন অনেক বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের মানুষ। কেবল জার্মানের ৭ মিলিয়ন জার্মানি নিহত হন, যার মধ্যে ২ মিলিয়ন সাধারণ জনতা।
সোভিয়েত ইউনিয়নে কেবল ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দুই হাজার লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৫০০ জন কারাগারে এবং কনসেন্টেশন ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে ২৭ জন জ্যোতিবিদ গুম হন। জোশেফ স্ট্যালিনের মার্কসীয় মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন লেখকরা। বিপ্লব বিরোধী কর্মকা- এবং অপতৎপরতার জন্য আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক লেখক। জার্মানের ইহুদী বুদ্ধিজীবী ওয়ালটার বেনজামিনকে স্টালিনের গুপ্তচর ১৯৪০ সালে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও সেই সময় সেপ্টেম্বরে তার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়েছিল। লেখক ও সমালোচক এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তির করুণ পরিণতি এভাবে এসেছে। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান থেকে পালিয়ে আসা যেসব ইহুদীরা গঠন করেছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন এবং স্ট্যালিন যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন; ১৯৪৫ সালের পর যুদ্ধ শেষে ¯œায়ু যুদ্ধের সময় তারাই হয়ে গেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু। কেবল সেই সংগঠনের সদস্যরা নন তাদের সঙ্গে অনেক নিরীহ ইহুদীদের হত্যা করা হলো সোভিয়েত বিরোধী হিসেবে। রাজনীতির জটিল তন্তুজালে আবদ্ধ হলেন বুদ্ধিজীবীরা। ইতালীয় ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা বুদ্ধিজীবী ছিলেন গিয়োভান্ন। ১৯২৫ সালে ফ্যাসিবাদের যে ধারণার সূচনা তা মুসলিনের দ্বারা কৃতিত্ব হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের সময়।
বিপরীতে আন্তোনিও গ্রামশির সঙ্গে ছিল তার তত্ত্বের ভিন্নতা। এজন্য গ্রামশিকে জেল খাটতে হয়েছে অনেকদিন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ১৯৩৬ সালে বুদ্ধিজীবীদের বিপক্ষে শাসক শ্রেণির অবস্থান গিয়োভান্ন ধারণার পরিণাম। সে সময় কবি লোরকাকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা।
কিউবান গেরিলা নেতা, চিকিৎসক, লেখক বিপ্লবী আর্নেস্ট চে গুয়েভারা ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় ধৃত হয়ে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। অথচ চে গুয়েভারা সম্পর্কে জা পল সার্ত্র বলেছেন, ‘হড়ঃ ড়হষু ধহ রহঃবষষবপঃঁধষ নঁঃ ধষংড় ঃযব সড়ংঃ পড়সঢ়ষবঃব যঁসধহ নবরহম ড়ভ ড়ঁৎ ধমব’ ধহফ ঃযব ‘বৎধ’ং সড়ংঃ ঢ়বৎভবপঃ সধহ.’ এভাবে পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই নতুন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছে; গণতন্ত্র ফিরে এসেছে কিন্তু প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে।
৩. বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট ও চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে ১৯৭১ সালের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত উপমহাদেশের দেশভাগ পাল্টে দিয়েছিল আগের সব হিসেব-নিকেশ। এই শতাব্দীতেই বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন সময়ে খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ শে মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তার স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মত বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
৪. সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী যারা ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবহারিক জীবনের চেয়ে ভাববাদী জগতের মানুষ হয়েও মানবকল্যাণে কাজ করেছেন তারাই যুগে যুগে নির্যাতিত হয়েছেন। নির্মম মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ শহীদদের নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে সক্রেটিস কিংবা হুমায়ুন আজাদ হয়ে উঠেছেন নতুন শতাব্দীর দিশারি। হত্যার নির্মমতা তুচ্ছ হয়ে গেছে তাদের চিন্তা-ধারা ও সৃষ্টিশীলতার কাছে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্পাদনা : মোহাম্মদ আবদুল অদুদ