মুনাফার লোভে সবাই যদি মানুষ মারতে চায় তবে আমরা বাঁচব কীভাবে?
ড.সা’দত হুসাইন : এবারের রমজানে ভ্রাম্যমাণ আদালত সমূহকে বেশ তৎপর দেখা গেছে। তারা বিভিন্ন রকম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছে। এদের মধ্যে খবারের দোকান ও খাবার প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরির সংখ্যা সব চাইতে বেশি। ঔষধের দোকান, কেমিক্যালের আড়ত ইত্যাদিতেও অভিযান চালানো হয়েছে। আমরা খাবারের দোকান এবং খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকা-ের ওপর আলোচনা সীমিত রাখব। প্রথম চোখে পড়ার মতো অভিযান চালানো হলো আমের বাজারে। বাগানে তখনো আম পাকতে শুরু করেনি। অথচ বাজারে বিক্রি হতে শুরু করেছে পাকা আম। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নেমে আম পরীক্ষা করে দেখতে পেল যে, এগুলো আসলে কাঁচা আম। ইথোফেন, কার্বাইড ইত্যাদি কেমিক্যাল প্রয়োগ করে কাঁচা আমকে পাকা আমের রূপ দেওয়া হয়েছে। কাটার পর দেখা গেল এসব আমের আঁটি একেবারেই কাঁচা। স্বাদের দিক থেকেও এগুলো বোধহয় পানসে হবে। বেশির ভাগ লোকই মনে করে, কেমিক্যাল সহযোগে পাকানো আম শরীরের জন্য ক্ষতিকর, যদিও নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তরের বক্তব্য একটু ভিন্নতর। ভোক্তারা যে এ ধরণের আম কিনে ঠকেছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাল হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মিষ্টির দোকানে। এখানে দেখা গেল পঁচা, বাসী দুগন্ধযুক্ত, বিষাক্ত খাদ্য দ্রব্যে দোকানগুলো ভর্তি হয়ে আছে। নাম করা বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্ট যাদের ওপর এতদিন পর্যন্ত আস্থা স্থাপন করে ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে খাদ্য সামগ্রী ক্রয় করেছে, তারাও নির্লজ্জভাবে এ মারাত্মক খেলায় মেতে উঠেছে। এরা মানসম্মত খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সাধারণ দোকানের চাইতে দুইগুন, তিনগুন বেশি দাম হাতিয়ে নিচ্ছে। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ দোকানের চাইতে নি¤œ মানের ক্ষতিকর সামগ্রী সুন্দর প্যাকেটে গছিয়ে দিচ্ছে।
বড় বড় নামকরা ক্যাটারার, হোটেল, রেস্টুরেন্ট যে সব জায়গা থেকে খাদ্য-সামগ্রী ও খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে যেখানে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখতে পেয়েছে যে, চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুত করা হচ্ছে। নামি-দামি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্যাটারার মুনাফার লোভে অতি নি¤œমানের পঁচা, বাসী খাদ্য- উপাদান কিনে এনে তা দিয়ে তাদের খাদ্য সামগ্রী তৈরি করে উচুঁ দামে গ্রাহকের কাছে তারা এসব বিক্রি করছে। গ্রাহকের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে তারা এরূপ ক্ষতি খাদ্য সামগ্রীর পসরা সাজিয়েছে। গ্রাহক যে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা সহজে অনুমেয়।
ছোট দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলে,‘আমরা তো বড় সরবরাহকারী বা আড়তদার থেকে জিনিসপত্র কিনেছে। আমরা জানি না এর গুণগতমান কীরূপ।’ ছোট দোকানদারদের বক্তব্যে হয়তো কিছুটা যুক্তি আছে। পুরো নয়। কারণ ব্যবসায়ের লক্ষ্যে পণ্য-সামগ্রী কেনার বেলায় তার চোখ কান খোলা রাখতে হবে। যে সামগ্রী সে কিনছে তা গ্রাহকের খাওয়ার উপযোগী হতে হবে। সে দায়িত্বের কিছু অংশ হলেও খুচরা বিক্রেতাকে বহন করতে হবে। চেইন স্টোরের মালিকরা পণ্যের উৎসকে দোষারোপ করতে পারেন না। কারণ উৎস তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সেখানে পণ্যের মূল মালিক বা উৎপাদনকারীর সাথে তারা দরকষাকষি করতে পারেন। তাদের পারদর্শী কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। তারা দেখে শুনে দাম-দর করে পণ্য সামগ্রী কিনেন। এ জন্য তারা পণ্যের ক্রয় মূল্যের ওপর বিপুল পরিমাণ দাম বাড়িয়ে দেন। যখন উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো বিশেষ পণ্য, যেমন মাংস নির্দিষ্ট দামে (যা যৌক্তিক হয়ে থাকে) বিক্রির নির্দেশ যেন তখন চেইন স্টোর সে দাম ধরে নিয়ে উৎস বিক্রেতার নিকট থেকে মাংস (বা গরু, ছাগল) কিনবেন। চেইন স্টোর থেকে বিক্রেতারা বেশি দাম নিতে পারে না, চেইন স্টোর দলে বলে নির্ধারিত দামের ওপরে মাংস না কিনলে মূল বিক্রেতা তার পণ্য বিক্রি করতে পারবে না। চেইন স্টোর যদি নির্ধারিত দামে মাংস বিক্রি করে তবে অপর বিক্রেতারা এ দামে মাংস বিক্রি করতে বাধ্য হবে। এবারের রমজানে তা সরে জমিনে প্রমাণিত হয়েছে। রমজানের সপ্তাহ খানেক আগে এবং রমজানের শুরুতে চেইন স্টোর ও অন্যান্য বিক্রেতা কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত দামের চাইতে অনেক বেশি দামে মাংস বিক্রি করেছে। দু-তিনটি চেইন স্টোরে অভিযান চালিয়ে বেশি দামে মাংস বিক্রির দায়ে যখন তাদের জরিমানাসহ নানাবিধ শাস্তি দেওয়া হয়েছে তখন তারা নির্ধারিত দামের কিছু নীচে মাংস বিক্রি করেছে। তাদের দেখাদেখি হাটে বাজারের কসাইরা মাংসের দাম নামিয়ে এনেছে রোজায় এবার মাংসের দাম নির্ধারিত সীমার মধ্যেই ছিল। চেইন স্টোরের ওপর তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর থাকলে অন্য ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারে না।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক মানদ-ের রিচারে যৌক্তিকভাবে স্বার্থ-সচেতন (জধঃরড়হধষ ঊপড়হড়সরপ ধমবহঃ)। তারা পুরস্কার-তিরস্কার (ওহপবহঃরাব ঝঃৎঁপঃঁৎব) খুব সহজে বুঝতে পারে। যখন তারা বুঝতে পারবে যে, অনৈতিক কাজ করলে, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে তখন তারা সে কাজ থেকে সরে আসবে। আর যদি বুঝতে পারে যে অনৈতিক কাজ করে, অপরাধ করে কোনো শাস্তি পাবে না, বরং পুরস্কৃত হবে তখন তারা অনৈতিক কাজ করবে, অন্যায় করবে, অপরাধ করবে।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব