মিডিয়া, দায়িত্ব তোমাকে দায়িত্বশীল করে না বন্ধু?

     

    ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

    বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের ইফতার পার্টিতে গিয়েছিলাম। অসাধারণ এক আয়োজন। বিদেশের মাটিতে এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কী করে যে ওরা এত চমৎকার আয়োজন করে! আমি নিজেও জীবনে এই প্রথম নুপুরজানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শ’ খানেক সিঙ্গারা বানিয়ে নিয়ে গেলাম। কমিউনিটির অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। একফাঁকে ৯ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ঈদ আনন্দ আড্ডা নিয়েও মিটিংও সারলাম। ফেরার পথে হ্যামিল্টন স্টেশন থেকে সিডনি থেকে আগত লেখক ড. শাখাওয়াৎ নয়নকে তুলে নিয়ে বাসায় এলাম।

    বাসায় ফিরে ফেসবুকে অনুজপ্রতীম লেখক ডা. নাজমুল হাসানের পোস্ট দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। চট্টগ্রামে মিতু হত্যার ছক নাকি স্বয়ং এসপি বাবুল আক্তারই কষেছেন! স্ত্রীর অপ্রতিরোধ্য পরকীয়া প্রেম ঠেকাতে না পেরে পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারই পরিকল্পনামাফিক ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করিয়েছেন। নাজমুল খবরের লিংকও দিয়েছে। নামহীন-গোত্রহীন নিউজ পোর্টাল নয়, রীতিমতো শীর্ষ মিডিয়াগুলোর অনলাইন ভার্সনে এই নিউজ। সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপির কিছুটা রহস্যে ঢাকা ভাষ্য। সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার হতে সময় লাগেনি। স্ত্রী হত্যার দায়ে এসপি বাবুল আক্তার গ্রেফতার শীর্ষক খবরও চাউর হতে লাগল।

    বিভ্রান্তি কাটতে অবশ্য একদিনও লাগেনি। পুলিশের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে বাবুল আক্তার বাসায় ফিরে এসেছেন। মিতু হত্যার প্রত্যক্ষ খুনিদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যই পুলিশ তাকে ডেকে নিয়েছিল। তাকে ডেকে নেওয়ার পর আমরা সামান্য ধৈর্য ধরতে পারিনি। এমন কী মনগড়া আজগুবি একটা খবর প্রচার করে আমাদের মিডিয়া পুরো ঘটনাটাকেই ভিন্নখাতে ঠেলে দিয়েছিলেন। কারা করেছেন এই কাজটা? এটা কি মামুলি কোনো ভুল? নাকি মূল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য সুপরিকল্পিত কোনো ফাঁদ, যাতে পা দিয়েছেন অনেকগুলো মিডিয়া। ঘটনাটি যারাই উপস্থাপন করুক না কেন, তাতে নিপুনতার ছাপ ছিল নিঃসন্দেহে।

    বাবুল আক্তারের স্ত্রীর হত্যাকা- নিয়ে সমগ্র জাতিরই একটি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দেখবার জন্য আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে আছি। পুলিশ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীও মিতু হত্যাকা-ের একটা সুরাহা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পুলিশের একজন এসপি হিসেবে এটা খুব স্বাভাবিক যে তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে তার সম্পৃক্ততা আমজনতার চাইতে একটু বেশি হতেই পারে। ব্যাপারটা অনেকটা ডাক্তারদের অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত থাকার মতো। অপারেশন টিমের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও নিকটতম আত্মীয়ের অপারেশনের সময় অনেক চিকিৎসকই অপারেশন থিয়েটারে উপস্থিত থাকেন। নিজের একটা ঘটনা বলি, আমি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ি। বাবার বন্ধু তাহের কাকার স্ত্রীর গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়ল। কাকী কিছুতেই অপারেশন করাবেন না, এদিকে ব্যথাও মাঝেমধ্যে অসহ্য হয়ে উঠছিল। কাকীকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করা হলে তিনি এক শর্তে রাজি হলেন। অপারেশন করার সময় থিয়েটারে মিল্টনকে থাকতে হবে। আমার এখনও মনে আছে, আমি অপারেশন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কাকী আমার হাত ধরে আছেন আর আস্তে আস্তে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এটি কিন্তু সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। আর আলোচ্য ঘটনায় বাদী স্বয়ং এসপি বাবুল আক্তার এবং খুনের ঘটনায় তার পুরনো দুই সোর্সও জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। সুতরাং বাবুল আক্তার যে মাঝেমধ্যেই পুলিশী তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের অংশ হবেন এটাই স্বাভাবিক।

    আমরা সবাই সজাগ থাকি, চোখ-কান খোলা রাখি আর পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বাহিনীসমূহকে তাদের কাজ করতে দেই। মিথ্যে নয়, প্রকৃত সত্যের উদ্ঘাটন হোক, প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়ুক এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোকÑ এটাই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

    লেখক : কবি ও চিকিৎসক, অস্ট্রেলিয়ায় নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত

    সম্পাদনা : জব্বার হোসেন

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *