
সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার নীতিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে কী ঘটছে
ঋষি আয়াঙ্গার : সম্প্রতি বাংলাদেশে এক হিন্দু আশ্রমকর্মী, এক হিন্দু পুরোহিত ও এক সন্ত্রাসবিরোধী পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রীকে খুন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে এদের সবাইকে হত্যা করা হয়।
সর্বশেষ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ২০১৩ সালের পর থেকে কমপক্ষে ২০ জন হত্যাকা-ের শিকার হলো। এ হত্যাকা- মূলত মুসলিম রাষ্ট্রে বিগত তিন বছর ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার একটি অংশ। শাহবাগ আন্দোলনে সম্পৃক্ত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে টার্গেট করার মাধ্যমে এ সহিংসতা শুরু করা হয়। পরে শিগগিরই এ টার্গেট অন্যান্যের প্রতি সম্প্রসারিত হয়। হত্যা করা হয় এক এলজিবিটি ম্যাগাজিন সম্পাদক, এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও দুই বিদেশিকে। দুই বিদেশির একজন ইতালির নাগরিক ও অপরজন জাপানি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কাউন্সিলের ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সিনিয়ার সহকর্মী অ্যালিসা আইরেজ টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, বাংলাদেশে আমি প্রকৃতপক্ষে অন্যতম একটি বড় হতাশাজনক অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের চমৎকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখ করার মতো বিষয় ছিল, সহিংস উগ্রবাদ প্রতিহত করতে ছিল মধ্যমপন্থি সমাজ।
আরেকটি অরাজক বিষয় হলো, বেশিরভাগ হত্যাকা-ের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের প্রকাশ্য দিবালোকে ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। যার দায় স্বীকার করেছে ইসলামি স্টেট (আইএস)। এছাড়া অন্যান্য কয়েকটি ঘটনায় আল কায়েদার ভারত উপমহাদেশীয় শাখা (একিউআইএস) দায় স্বীকার করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দেশে এ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের উপস্থিতিকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে। সরকার দোষারোপ করে দেশি মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে এ অপকর্ম করছে। তবে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে বিপথে পরিচালিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এমনকি তারা এও বলেছেন, এর ফলে মৌলবাদী ইসলাম আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়বিষয়ক বিশ্লেষক ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি. ক্রিস্টিন ফেয়ার বলেন, রাষ্ট্র সহিংসতা পরিচালনাকারীদের পরিবর্তে রাজনৈতিক অপরাধীদের উপর নজর দিচ্ছে। এ পরিবেশের সুযোগে আইএস ও একিউআইএস দায়মুক্তির সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ও উদারপন্থি এলিটদের ঝুঁকিতে রেখেই সরকার এসব উপেক্ষা করে চলেছে।
ইলিনিয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ-আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রিয়াজ বলেন, ১৯৯০ সালের পর প্রায় ক্ষেত্রেই দেশের ইসলামি মৌলবাদীদের বহিরাগত সংযোগ ও সম্বন্ধ ছিল। টাইম ম্যাগাজিনকে রিয়াজ বলেন, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছেÑ এমনটি বলা ভ্রান্তিকর ও ফলদায়ক নয়। আজকের দিন বা যুগে আইএস অথবা একিউআইএস কোথাও শারীরিকভাবে উপস্থিত হবে না। তারা আদর্শিকভাবে বক্তব্য রেখে পরদেশে আক্রমণ করছে। তাদের বর্ধিত লক্ষ্যমাত্রায় তারা আরও কাছাকাছি চলে আসতে পারে বলে ইঙ্গিত বহন করে।
অতি সম্প্রতি সিরিজ হত্যাকা-ের প্রতিক্রিয়ায় সরকার নির্বিচার দমন অভিযান পরিচালনা করছে। গত সপ্তাহে হিন্দু আশ্রমকর্মী নিহতের পর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ কয়েক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। যদিও সংবাদে বলা হয়, আটককৃত ১১ হাজারের অধিক ব্যক্তির মধ্যে মাত্র ১৪৫ জন্য সন্দেহভাজন ইসলামি জঙ্গি।
রিয়াজ আরও বলেন, গণগ্রেফতারে বাংলাদেশি জনগণের আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ গ্রেফতার করে এমন বার্তা প্রেরণ করা যাবে না যে, এই অভিযান জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সব সম্প্রদায়কে একত্রে করতে সাহায্য করবে। আমি নিশ্চিত যে, আটককৃত এসব মানুষের মধ্যে অন্তত একজন হলেও সম্পূর্ণ নির্দোষ ব্যক্তি রয়েছে। এখন প্রশ্ন, তার পরিবারের কী হবে? তার মনোভাবের অবস্থাই বা কী হবে?
বৃহত্তর অর্থে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষায় সরকারের নিস্তেজতা সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদের প্রজনন কেন্দ্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসিনা এসব হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়েছেন। তবে তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘মুক্ত কথা’র মাধ্যমে কারো অনুভূতিতে আঘাত হানা উচিত নয়। তিনি বলেন, কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে কারোর লেখা বা কথা বলার কোনো অধিকার নেই।
বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের জঘন্য বক্তব্যের সমালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক তেজশ্রী থাপা বলেন, সরকারের নাগরিকদের সুরক্ষা করার ধারণা তাদের আরও নিশ্চুপ করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, তুমি বলতে পার না যে, ‘এসব হত্যাকা-ে তুমি উদ্বিগ্ন’ এবং আবার একই নিশ্বাসে তুমি বলতে পার না যে, ‘তোমার এসব বলা উচিত নয়’।
বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধর্মীয় নিয়মের সরকার পরিচালনার পরিবর্তে একটি পৃথক বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের জ্বলন্ত আকাক্সক্ষা নিয়েই এর সৃষ্টি হয়। বিগত কয়েক বছর ধরেই অসহিষ্ণুতার দিকে অশুভ ঝোঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আইএসের মতো গোষ্ঠীগুলোর দক্ষিণ এশিয়ায় পা রাখার জায়গা তৈরি করার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ তাদের উর্বর ভূমি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব ঘটনা এ অঞ্চলের জন্য ভীতিকর প্রভাবের ভবিষ্যদ্বাণী করে। গত বছর সিঙ্গাপুর থেকে কয়েক ডজন বাংলাদেশিকে আটক করে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দেশটির সরকার অভিযোগ করেছে, তারা তাদের নিজ দেশে হামলা করার পরিকল্পনা করছিল।
রিয়াজের তথ্য মতে, সরকার যদি গণতান্ত্রিক অভিব্যক্তির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে কাজ না করে, তাহলে তা কেবল সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোতে যোগদানের বিষয়টি আরও সহজ করবে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ খুবই শক্তিশালী, স্পন্দনশীল। ক্রমবর্ধমান জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে একমাত্র তারাই পরাজিত করতে পারে। তবে তাদের কথা বলার জায়গা থাকতে হবে।
এখন যেহেতু বাংলাদেশিদের মধ্যে অপরাধীরা খুবই কম সমর্থন পায়। তবে ভিন্নমত দ্রুত সংকো
