সৈয়দ আশরাফ ও জাসদের রাজনীতির ‘পেন্ডোরা বক্স’
মোহাম্মদ আলী বোখারী টরন্টো থেকে
‘জাসদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক-বাহকেরা শতভাগ ভ-’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এমন মন্তব্যে ক্ষমতাসীন জোটের শরিক জাসদের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই মন্তব্যটি গত ১৩ জুন সৈয়দ আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্রে ছাত্রলীগের আয়োজিত এক বর্ধিত সভা ও কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠানে করেন।
মোদ্দা কথায়Ñ সেখানে সৈয়দ আশরাফ বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগের একটা অংশ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নিয়ে আসে, সেটির ধারক-বাহকেরা দেশটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং পরে জাসদ নামে নতুন দল গঠন করে। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্নখাতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ যেন কোনোদিন কার্যকর রাষ্ট্র না হতে পারে, সেটাই জাসদ চায়; আজ তারাই আমাদের লেজুড়বৃত্তি করছে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে তার প্রায়শ্চিত্ত সারাজীবন করতে হয় বলেও মন্তব্য করেন। এসব কথার বাইরেও তার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে- বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে জাসদ, তারা যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি না করত, তাহলে আজ বাংলাদেশ ভিন্ন বাংলাদেশ হতে পারত।
এতে পরদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আপনি আপনার জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে থামান, তা না হলে ১৪ দলের ঐক্য থাকবে না। তিনি বলেন, যখন জঙ্গিরা মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে, তখন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ‘জাসদ থেকে মন্ত্রী করায় সরকারকে পস্তাতে হবে’Ñ এমন উক্তি করায় ১৪ দলের ঐক্য থাকবে কি থাকবে না, সেটা দেখতে হবে। সৈয়দ আশরাফকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, আমাদের সামনে জাতির জনক আছে, সুতরাং এ ভুল আর করবেন না।
কিন্তু এ বিতর্কের ইতিবৃত্তটি কী? উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নামেই দুটি পৃথক দল অর্থাৎ নামগতভাবে একটিকে ইংরেজি আদ্যাক্ষর অনুসারে ‘জেএসডি’ ও অপরটিকে বাংলা আদ্যাক্ষর অনুসারে ‘জাসদ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০২ সালে বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু-র নেতৃত্বাধীন জাসদ দ্বিখ-িত হয়ে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আসম আবদুর রবের নেতৃত্বে অপর একটি জাসদে আবির্ভূত হয়, যা ‘জেএসডি’ নামে পরিচিত। আপাতদৃষ্টিতে ইংরেজি ও বাংলার আদ্যাক্ষরের অস্তিত্বে বিভাজিত এ দলটি যেমন ভিন্ন দৃশ্যপটে আবর্তিত, তেমনি স্বাধীনতা উত্তর তাদের ছাত্রসংগঠনটির পরিচিতিটিও ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগের অনুকরণে জাসদ ছাত্রলীগ, কেননা তা আওয়ামী ছাত্রলীগ থেকেই উদ্ভূত। তথাপি অবিভক্ত জাসদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং রক্ষী ও লাল বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদে একটি বিক্ষোভ প্রদর্শনের কৃতিত্ব আসম আবদুর রবকে দেওয়া হয়। কেননা ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ তারই নেতৃত্বে রমনায় একটি বিক্ষোভ র্যালি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে, যা ইতিহাসে ‘রমনা ম্যাসাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত। এ ‘রমনা ম্যাসাকার’ প্রসঙ্গে মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত ও প্রথমা প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত ‘জাসদের উত্থান ও পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি’ গ্রন্থটির উদ্ধৃতি দিয়ে উইকিপিডিয়ায় বর্ণিত যে, ওই বিক্ষোভের ঘটনায় জাসদের কমপক্ষে ৫০ জন নেতা-কর্মী রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়। এতে বলা হয়, ওই ঘটনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিক্রিয়াশীল ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির অভ্যুদয় ঘটে এবং প্রাণরক্ষায় জাসদ কর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায় এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান অবধি সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত থাকে। এছাড়াও সেটির নেপথ্যে বর্ণিত, একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর একটি আদর্শিক প্রশ্ন দেখা দেয় কীভাবে এ স্বাধীন বাংলাদেশটি চলবে? তখন প্রথমভাগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করলেও আসম আবদুর রব ও শাহাজাহান সিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি বৃহৎ অংশ তা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের অধিকাংশই রাজনীতির তাত্ত্বিকগুরু হিসেবে বিবেচিত সিরাজুল আলম খানের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এ জাসদ দলটি সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের ২৫ মাসের দায়িত্ব পালনরত মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বৈরশাসন, নাগরিক নির্যাতন ও অথর্ব ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিবাদে ১৫ মার্চের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারিত ২৯ দফাসম্বলিত একটি ইশতেহার ঘোষণাসহ ১৭ মার্চ চরম পরিণতির হুঁশিয়ারি দেয়। কিন্তু ১৭ মার্চ পল্টনের জনসভা শেষে সন্ধ্যায় রমনায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর কাছে একটি স্মারক হস্তান্তর করতে গেলে ওই ৫০ নেতা-কর্মী নিহত হয়। আসম রবের বর্ণনা মতে, তিনি এবং মেজর জলিল ও মমতাজ বেগম ঘটনাস্থলে একত্রে দাঁড়িয়েছিলেন। অতর্কিতে রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ গুলি শুরু করলে ইনু তাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলেন। বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছিল। হঠাৎ দেখেন ইডেন কলেজের মুকুল দেশাই এবং কাছে থাকা জাহাঙ্গীর সেই গুলিতে প্রাণ হারান। পরে গুলিতে আহত অবস্থায় তিনিসহ মেজর জলিল, মমতাজ বেগম, মহিউদ্দিন খান বাদল ও অন্যদের গ্রেফতার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এছাড়াও তেজগাঁ থানার উপ-পুলিশ সুপারের ভাষ্য মতে, সেদিন রক্ষীবাহিনীর ট্রাকে করে ৪০-৫০টি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা হয়। এ সরেজমিন সংবাদ প্রকাশে জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ পদক্ষেপ নিলেও রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ পত্রিকাটির অফিস ঘেরাও করে সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালে এরশাদ শাসনামলে আসম রব জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হন। পাশাপাশি একই প্রধানমন্ত্রীর অধীনে বর্তমানে তথ্যমন্ত্রী হয়েছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
তাই প্রশ্ন জাগেÑ এত বছর পর কেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শরিক জোট জাসদের রাজনীতির ‘পেন্ডোরা বক্স’টি খুলেছেন?