হঠাৎ কেন জাসদ বিতর্ক
রাশিদ রিয়াজ : জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদকে নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতা লাভের পর মূলধারার রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মধ্যদিয়ে যে রাজনীতি শুরু করে জাসদ তা একপর্যায়ে রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিরোধিতা এবং বিপ্লবের জন্য জিয়াউর রহামানকে নির্বাচন করে যে মস্ত বড় ভুল করেন কর্নেল তাহের তা তাকে জীবন দিয়ে পরিশোধ করতে হয়েছে। কমবেশী এসব ঘটনা বিভিন্ন বইয়ে এসেছে এবং তা সবার জানা থাকলেও জাসদ তার কৃতকর্মের জন্যে এখনও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারেনি। জাসদের এই অবশিষ্ট দায় দায়িত্বের মধ্যে নতুন করে ফের কেন জাসদের অতীত ভূমিকা স্মরণ করিয়ে দেয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর জন্যে প্রয়োজন তার ভাল ব্যাখ্যা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দিতে পারবেন। রাজনৈতিকভাবে নিজ দলের নেতাকর্মীদের রাজনীতির অতীত ইতিহাস পাঠের মধ্যদিয়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে যে কঠিন সতর্কতার প্রয়োজন পড়বে তা চর্চার যুক্তিযুক্ত প্রয়োজন রয়েছে। যদিও জাসদের অনেক নেতা চান না এ নিয়ে আর কোনো কথা হোক। তাতে তাদের ভয় ১৪ দলীয় জোটে তারা টিকে থাকতে পারবেন কি না।
হঠাৎ করেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকে জাসদ সম্পর্কে সাবধান করে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা কি? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এধরনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। খালেদ মোশাররফ হত্যা মামলার সুরাহা আজও হয়নি? তার স্বজনদের কেউ কি নতুন করে কোনো মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন? ক্ষমতার অংশীদারিত্বে জাসদ কি বিপদজনকভাবে কোনো ধরনের সীমা অতিক্রম করতে যাচ্ছে? জাসদের যে সব ভুল সিদ্ধান্ত রয়েছে তা নিয়ে কিন্তু খোলামেলা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন বইতে বিশ্লেষকরা এক গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। জাসদ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘জাসদের উত্থান ও পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ বইটি এদিক থেকে প্রামাণ্য এক দলিল বলা যায়। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ছাড়া বিরোধী দলের তেমন কোনো অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না তখন কি ফের জাসদ নতুন করে কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা নিতে যাচ্ছে? আগামী দিনে জাসদের ভূমিকা কাজে লাগিয়ে অতীতের মত জাতীয়তাবাদী ও প্রবল কোণঠাসা হয়ে পড়া ইসলামী ধারার রাজনৈতিক শক্তি ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠার একটা সুযোগ পাবে নাতো।
বিশ্লেষকদের মধ্যে এমন ভাবনাও রয়েছে যে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্যে শক্তিশালী একটি বিরোধী প্লাটফরম দরকার। তৃণমূল শক্তিশালী করে বিএনপি দাঁড়াতে পারছে না এবং জাতীয় পার্টি অথর্ব হয়ে থাকার মত সরকারের গৃহপালিত বিরোধীদল হয়ে থাকার মাঝখানে জাসদ কি কোনো ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। যদি জাসদ আগামী দিনে শক্তিশালী এক বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করে তাহলে কি অতীতের মত গণবাহিনীর প্রয়োজন পড়বে? জঙ্গি ও টার্গেট কিলাররা কি জাসদের রাজনীতির আশ্রয়ে চলে যাবে এমন আশংকাও রয়েছে। ভূকৌশলগত কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সুযোগসন্ধানী বিদেশি শক্তিগুলো কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তা কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তি সামাল দিতে পারবে।
হ্যা, জাসদ গণবাহিনী তৈরি করে অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বলা যায় রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছে। কনভেনশনাল সেনাবাহিনীকে মিলিশিয়া বাহিনীতে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছে। সেই সময়ের জাসদের অসংখ্য ত্রুটি বিচ্যুতি হালকাভাবে হোক বা মৃদুভাবে হোক দলটির অনেক নেতা তা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে জাসদ রাজনৈতিক একটি অবস্থান থেকে তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে পরিশোধিত উপায়ে আগামী দিনের রাজনীতিতে যাওয়ার পথরচনা বা কোনো দিকনির্দেশনা দেয়নি। ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে জাসদ বিতর্ক দলটিকে কোথায় নিয়ে যাবে এমন প্রশ্নও উঠেছে।
নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে জাসদের সাম্প্রতিক মনোমালিন্যের অভ্যন্তরে আরও কি কি রাজনৈতিক উপাদান রয়েছে যা আগামী দিনে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দানা বেঁধে উঠতে পারে? ৭৩’এর নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংগঠন ও অঙ্গ সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন আজকের জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু একটি অঙ্গ সংগঠনের মূল দায়িত্ব পান। এবারও কি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইনু কোনো উদ্যোগে সক্রিয় হয়ে উঠবেন?
জাসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল হিসেবেই বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটে রয়েছে। এ চেতনায় দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর যথেষ্ট সময় না দিয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মৃত্যু চেয়েছিল জাসদ। ফলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা। কিন্তু এর কোনো দায়দায়িত্ব জাসদ নেতারা নিতে চান না। আবার অন্যদিকে জাসদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, পাল্টা জাসদের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছে যার কোনো বিচার এখনও হয়নি। আর এখন জাসদ বিতর্কে দলটি কি ফের প্রস্তুতিবিহীন নতুন কোনো রাজনৈতিক অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে যাচ্ছে?