ইউরো কড়চা
শেখ মিরাজুল ইসলাম
ইউরো ফুটবলে রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, অস্ট্রিয়া, তুরস্ক, ইতালি এইসব দেশের খেলা দেখার পাশাপাশি তাদের ইতিহাস মনে পড়ছিল। তাদের শত বছর আগের যুদ্ধগুলো এখন খেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইউরোপের তাবৎ ইতিহাসে এশিয়া মাইনর বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব ও ভূমিকা সরাসরি ছিল। শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে পশ্চিম ইউরোপ আলোর বাসিন্দা হলেও পূর্ব ইউরোপ দফায় দফায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত হয়েছে এবং উঠেও দাঁড়িয়েছে কিন্তু তাদের সঙ্গে হাজার বছরের ব্যবসারাজনীতির সংযোগসূত্রে থাকা গোটা মধ্যপ্রাচ্য হয়ে পড়ছে ক্রমে অন্ধকারময়।
মধ্যপ্রাচ্যে জন্ম নেওয়া খৃষ্টধর্ম এখন ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকায় বিস্তৃত। বাইজেন্টাইন নকশা কাটা চার্চ আর ক্যালিগ্রাফির নকশা করা পুরনো মসজিদ ইউরোপে পাশাপাশি এখনও টিকে আছে। আইএস বা সন্ত্রাসবাদ এর ভিতরে ভাঙন ধরাতে চেষ্টা করলেও ইউরোপ ধৈর্য কতদিন দেখাতে পারবে তা দেখার বিষয়। সে যাইহোক, ইউরোপের ফুটবল উন্মাদনার সঙ্গে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিম-লের অনেক যোগসূত্র মিশে আছে। তাদের ফুটবলের ভাষা আলাদা। তবে ইউরোপের দলগত ‘পাওয়ার ফুটবলের’ পাশাপাশি একক নৈপুণ্যের আলাদা কদর আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাদের ক্লাব ফুটবলে তাই ল্যাটিন ফুটবলারদের কদর বেশি। অবশ্য ঔপনিবেশিক শাসনামলের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগটাও এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর। যে কারণে ইতালি ও স্পেনে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। ইংল্যান্ডে ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড, স্কটিশ ফুটবলারদের স্বাচ্ছন্দ্য। পর্তুগালকে একসময় বলা হতো ‘ইউরোপের ব্রাজিল’, ইউসেবিও-ফিগোদের সৌজন্যে। রোমানিয়ার ৯০ দশকের সেরা খেলোয়াড় গিওর্গি হাজিকে বলা হতো কার্পেথিয়ান ম্যারাডোনা, আর বর্তমান সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বেঁটে খাটো প্লেয়ার শাকিরিকে ডাকা হয় ‘আলপাইন মেসি’ নামে। উল্লেখ্য, শাকিরি একজন আলবেনিয়ান-সার্বিয়ান মুসলিম। আর হাজি এসেছেন আরোমেনিয়ান গোত্র হতে যাদের পূর্বপুরুষ অটোমান শাসনামলে বাইজেন্টাইন রোমানদের অংশ ছিলেন। আজকালের চক্রে ইউরোপ জুড়ে নিত্য নতুন অভিবাসী খেলোয়াড়দের মূল্যমান দিনদিন বেড়েই চলেছে। ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম এর বড় উদহারণ। ক্রমে অভিবাসী মুসলিম বংশোদ্ভূত ফুটবলাররাও আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো বা আফ্রিকার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মূল জাতীয় দলে জায়গা করে নিচ্ছেন। ফ্রান্সের জিদান, অরি, রিবেরি, আনেলকা, আবিদাল, সনিয়্যা, বেনজেমা, সামির নাসরি; সুইডেনের ইব্রাহিমোভিচ; হল্যান্ডের ভান পার্সি, ইব্রাহিম এফেলায় কিংবা জার্মানির ওজিল, খেদিরা; বসনিয়ার এডিন জেকো; বেলজিয়ামের ফেলিনিরা এর বড় উদহারণ। তাদের কারও কারও পূর্বপুরুষ অটোমান মুসলিম বা রোমান ক্রুসেডার ছিলেন বা কেউ ছিলেন যাযাবর। তাদের ব্যাপক প্রসারতা নিয়ে ভিতর ভিতর ইউরোপ কিছুটা হলেও চিন্তিত। যদিও ফ্রান্সে মুসলিম ফুটবলারদের সংখ্যাধিক্য আছে, তারপরও গুজব আছে বেন আরেফা ও বেনজেমাকে মূল দলে ফ্রান্স রাখেনি প্যারিসে হামলার জের ধরে।
তবে বাইজেন্টাইন ছকে আঁকা ইউরোপিয়ান ফুটবলে জাতিগত মতপার্থক্যে বাঙালি মুসলমানদের ভ্রুক্ষেপ নেই। ফ্রান্স-আলবেনিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মান-পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড-ওয়েলস, ইতালি-বেলজিয়াম, স্পেন-তুরস্ক এখনও ফুটবল মাঠে পুরনো লড়াইটায় পরোক্ষভাবে ঝালিয়ে নিচ্ছে।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন