সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় তোড়জোড় দেখালেও দৃশ্যত অগ্রগতি নেই
দীপক চৌধুরী : জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ‘অপ্রতিরোধ্য’’ তৎপরতায় হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা কমছে না। অপরাধী গ্রেফতারে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তোড়জোড় দেখালে বাস্তবে চাঞ্চল্যকর এসব হত্যাকা-ে গ্রেফতার নেই।
সরকার থেকে উদ্বেগ ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে বলা হলেও পরিবেশ সংখ্যালঘুদের স্বস্তি দেয়নি এখনও। গত কয়েকদিন ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, র্যাব হেডকোয়ার্টার্স পৃথক বৈঠক করলেও নিরাপত্তা বৃদ্ধি ছাড়া দৃশ্যত কোনো অগ্রগতি নেই বলে হিন্দু মহাজোট, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশন ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কয়েকজন নেতা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, হিন্দু অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় পূজাম-প, বৈষ্ণবআখড়া, মন্দির, খ্রিস্টানপল্লী, গীর্জায় পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। এমন জেলার সংখ্যা প্রায় ২০টি।
গত ৭ জুন ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী, ৫ জুন নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ এবং একই দিনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে খুনের ধরনে।
গত ৭ জুন মঙ্গলবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় গ্রামের মেঠোপথে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে (৬৯) গলাকেটে হত্যা করে মোটর সাইকেল আরোহী তিন যুবক।
ঝিনাইদহ উপজেলায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে গলাকেটে হত্যার ঘটনার পর গত ১৩ জুন সরকারের দায়িত্বশীল তিন মন্ত্রী নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন এবং হত্যাকা- সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। সেদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ঝিনাইদহ গিয়ে নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাস্থলের জায়গা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। মন্ত্রীরা নিহত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর স্ত্রীকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, যেকোনো মূল্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে। তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, পুরোহিত, সেবায়েত, খ্রিস্টান দোকানি হত্যায় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে হাজির হয়েছি, প্রাথমিকভাবে গ্রেফতারও করতে সক্ষম হয়েছি। এই হত্যাকা-টিও আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মূলত আন্তর্জাতিক মহলে এ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করতেই পরিকল্পিতভাবে এসব হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। তবে এ ধরনের হত্যাকা- ঘটিয়ে কাউকে ভয় দেখানো যাবে না। আমরা ইতিমধ্যেই অপরাধীদের শনাক্ত করেছি, গ্রেফতার করেছি। এ ধরনের ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে তাও পরিষ্কার।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, টার্গেট কিলিং ও জঙ্গিবাদ দমনেই সারাদেশে বিশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযানে কোনো ধরনের পুলিশি গ্রেফতার বাণিজ্য হয়নি। জঙ্গিও ধরা পড়েছে।
নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি ও ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত হত্যার পর সপ্তাহ না কাটতেই পাবনায় অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পা-েকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকা-ের ধরন দেখে স্থানীয় পুলিশ বলছে, নিত্যরঞ্জন পা-েকে পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে, দেখে মনে হয় খুনিরা তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল।
বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-মহাসচিব দীপক পিরিছ বলেন, সুনীল গোমেজ হত্যার পর দশ দিনের বেশি অতিবাহিত হলেও খুনিরা গ্রেফতার হয়নি। এ কারণে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর আগেও বনপাড়ায় গাব্রিয়েল কস্তা ও বীণা পিরিছকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয় গত ২৭ জানুয়ারি। মৃত্যুর মুখ থেকে তারা বেঁচে এসেছেন। কিন্তু তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। উপরন্তু অতীতে এ নির্মম ঘটনাকে ডাকাতির ঘটনা ‘প্রচার’ করে অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তখন কঠোরভাবে পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া হলে এখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন রকম হত। এক প্রশ্নের জবাবে এই খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতা বলেন, বাড়িঘর দখল করে আমাদের সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে দেশ ছাড়া করার, কিংবা বিতাড়িত করার কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না। এদেশ আমাদের। খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের নেতা দীপক পিরিছ বলেন, সংখ্যালঘু হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলছেন, যেভাবে আমাদের আশ্বস্ত করছেনÑতাতে আমাদের আস্থা আছে কিন্তু খ্রিস্টান পরিবারের ঘরে ঘরে পৌঁছায় না তার এসব ‘ম্যাসেজ’।
হিন্দু মহাজোট মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন বেড়ে চলছে, সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য কোনো ভূমিকা রাখছে না। হিন্দুদের অত্যাচার-নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে জানান, সন্ত্রাসী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এখন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।