সরকার দৃশ্যমান, আওয়ামী লীগ কোথায়?
ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
দেশে হঠাৎ করেই টার্গেট কিলিং বেড়েছে। এমন কী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সপ্তাহব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চলাকালীন সময়েও তারা পাবনার আশ্রমে হত্যাকা- ঘটিয়েছে। মাদারীপুরে কলেজ শিক্ষককে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সরকার পরিকল্পিত হত্যাকা- বন্ধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীসমূহও বসে নেই, তবু জঙ্গিদের নিত্য নতুন উদ্ভাবনী কৌশল তাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে। ক্ষেত্র বিশেষে জঙ্গিদমনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। কলাবাগানে জুলহাস-তন্ময়কে হত্যা করে পালাবার পথে পুলিশের সামনে পড়েও হাতাহাতি করে তারা ঠিকই পালিয়ে গেছে।
এখন কথা হলো, জঙ্গিদমন কি কেবলি সরকার ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীসমূহের? দেশে যারা পরিকল্পিত হত্যাকা- ঘটাচ্ছে তারা কি প্রচলিত অর্থে কেবলি সন্ত্রাসী? যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পর থেকেই দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সূত্রমতে, এই জঙ্গি তৎপরতায় মদদ দিচ্ছেÑ জামায়াত-শিবির এবং তাদের মিত্ররা। আইএসআই, মোসাদের মতো আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নেপথ্যে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করছে বলে শোনা যায়। অর্থাৎ একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ধর্মের নামে আজকাল মানুষ হত্যায় যারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থানটাও ভেবে দেখবার মতো। এখন আর কেবল মাদরাসার গরিব ছেলেরাই নয় বরং অনেক স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরাই এখন এই বিধ্বংসী পথে পা বাড়াচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। শুরুতে ধর্মের নামে দলে ভিড়ালেও বেছে বেছে এদের মধ্য থেকে একটা অংশকে হত্যাকা- ঘটানোর কাজে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে। জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা হিজবুত তাহরির মতো সংগঠনগুলো হলো জামায়াতের বি টিম। জামায়াত-শিবিরের স্বার্থ সংরক্ষণই তাদের উদ্দেশ্য। যুদ্ধাপরাধের দায়ে একের পর এক শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার প্রেক্ষিতে জামায়াত-শিবির যে চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, সেটা ভাবলে ভুল হবে। বরং রাজনীতির হিসেব অনুযায়ী তারা মরণ কামড়ই দিয়েছে। যেহেতু তারা একাত্তরের ভূমিকায় অনুতপ্ত নয়, মওদুদীর ভ্রান্ত ইসলামেই তাদের আস্থা, সেহেতু পরিকল্পিত হত্যাকা-ই তাদের বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল।
জামায়াত-শিবির ও তার দোসরদের রাজনীতিকে তাই নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি রাজনীতি দিয়েও রুখতে হবে। সেই দায়িত্বটি কাদের? কেবলমাত্র আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে জঙ্গি-সন্ত্রাস ও পরিকল্পিত হত্যাকা- বন্ধ করা যাবে না। এসব সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণ একবার জাগলে কোনো অপশক্তিই আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। মাদারীপুরের কলেজ শিক্ষক হত্যার ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনায় আমরা তার প্রমাণও পেয়েছি। সেখানে জনগণ সম্মিলিতভাবে ধাওয়া দিয়ে শিবিরকর্মী ফাহিম নামের একজন জঙ্গিকে ধরে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। জনগণকে জাগিয়ে তোলার, সচেতন করার প্রধান দায়িত্ব রাজনৈতিক দলসমূহের। সরকারের প্রধান শরীক দল এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে? কদিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ঢাকা শহরের প্রতিটা মহল্লায় সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী কমিটি গঠন করা হবে। পরবর্তীতে এই নিয়ে আর কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি, তাই জানি না তার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে? দেশের বর্তমান সংকটে আওয়ামী লীগের ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতা দরকার। জঙ্গিবাদ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলবার পাশাপাশি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ করে তুলতে হবে। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টেও জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। পারিবারিক পর্যায়ে অভিভাবকদেরও সচেতনতা প্রয়োজন, সন্তানদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে।
কেবল আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে জামায়াত-শিবির ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সন্ত্রাস-হত্যাকা- সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকেই রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি তার রাজনৈতিক ভূমিকা যথাযথভাবে পালন না করতে পারে, তাহলে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস বারবার ফিরে আসবে। কখনও পেট্রলবোমা হয়ে, কখনও বা পরিকল্পিত হত্যাকা-ের ধরনে, মাঝখান দিয়ে ভুগতে হবে সাধারণ জনগণকেই।
লেখক : কবি ও চিকিৎসক, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন