
বজ্র আটুনি ফস্কা গেরো

প্রভাষ আমিন
বাংলাদেশে ১০ কোটিরও বেশি মোবাইল সিমের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সাফল্যের সঙ্গে শেষ করায় মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে আন্তরিক ধন্যবাদ। বাংলাদেশে কোনো আলটিমেটাম সফল হয় না। কোনো হুমকি কার্যকর হয় না। ঢাকার রাস্তায় গাড়িতে আগে লেখা থাকত ‘সিটিং সার্ভিস’, কিন্তু সেই সার্ভিস ‘চিটিং সার্ভিস’এ পরিণত হওয়ার পর এখন লেখা হয় ‘আল্লাহর কসম সিটিং সার্ভিস’। বাঘ আসে, বাঘ আসে, গল্পের মতো মানুষ আর বিশ্বাস করে না। ট্যানারি শিল্প হাজারিবাগ থেকে সাভার চলে যাবে, এই গল্প শুনে আসছি কত বছর ধরে। বাঘা বাঘা মন্ত্রীরা কত আলটিমেটাম দিলেন, কত হুমকি দিলেন, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারানা হালিমকেও যারা বাকসর্বস্ব বাঘা মন্ত্রীদের মতো ভেবেছিলেন, তারা ভুল করেছেন। পহেলা জুন থেকেই এই ভুল ভাবুকদের ফোন বন্ধ হয়ে গেছে, এখন তারা হায় হায় করছেন। মেট্রিক পাশ না করেও প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায়, কিন্তু বায়োমেট্রিক পাশ না করলে বাংলাদেশে মোবাইল চালু রাখা যায় না।
শেষদিনে বায়োমেট্রিকের হয়রানি-ভোগান্তি নিয়ে এই কলামে লিখেছিলাম। তাতে অনেকে ভেবেছেন, আমি বুঝি তারানা হালিমকে অপছন্দ করি বা আমি বুঝি বায়োমেট্রিকবিরোধী। দুটোর কোনোটাই নয়। তারানা হালিম আমার প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন, এখন প্রিয় নেত্রী। আর আমি সবসময়ই মনে করি, বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের একটা ডাটাবেজ থাকা দরকার। আমাদের নীতিনির্ধারকদের দূরদর্শিতা থাকলে, শুরু থেকে এ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা হতো। তাহলে এখন আর কোটি কোটি মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হতো না। শেষদিনে রেজিস্ট্রেশন করতে গেলাম কেন, এ নিয়েও অনেকের প্রবল আপত্তি ছিল। আমি নাকি তারানা হালিমের বিরোধিতা করার জন্যই শেষদিনে হয়রানির নাটক করেছি। হা হা হা। আমি খুব অবাক হয়েছি। শেষদিন তো দিনের বাইরে নয়। একজন আইন মানা নাগরিক হিসেবে আমি এপ্রিল মাসেই আমার জিপি সিম তাদের ফার্মগেট আউটলেটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছি। ঝুলে ছিলাম এবং আছি এয়ারটেল নিয়ে। রেজিস্ট্রেশনের বিরোধিতাকারীরা আদালত পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন। লাভ হয়নি। তাদের মূল শঙ্কা ছিল, আঙুলের ছাপ এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিলে আমাদের নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। নিরাপত্তা নিয়েও আমার অত মাথাব্যথা নেই। প্রতিদিন ঘাড়ের ওপর চাপাতির অদৃশ্য উপস্থিতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। তাই আঙুলের ছাপ দিয়ে কে আমার কী গোপন তথ্য হাতিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা বিঘিœত করবে, তা নিয়ে সত্যি আমার মাথাব্যথা নেই। আমার মূল আপত্তি ছিল সিস্টেমে, হয়রানিতে। এমনিতে আমাদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। সব কাউন্টারেই লম্বা লাইন, স্টেডিয়ামের সামনে লাইন, ভারতের ভিসা পেতে লাইন। লাইনে লাইনে আমাদের জীবনটাই বেলাইন হয়ে যায় প্রতিদিন। সেখানে বায়োমেট্রিক আমাদের হয়রানির বোঝার ওপর শাকের আটি হয়ে এসেছিল।
বায়োমেট্রিকের রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে ১৮ দিন আগে। কয়টা রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, কয়টা বাদ পড়েছে, সব হিসাব ফাইনাল হয়েছে। এখন তো আমরা বায়োমেট্রিকের সাফল্যের আশা করতেই পারি। নিশ্চয়ই সন্ত্রাস কমে যাবে, টপাটপ সন্ত্রাসীরা ধরা পড়বে। কিন্তু ঘটছে উল্টো ঘটনা। টার্গেট কিলিং বেড়ে গেছে, খুনিরাও ধরা পড়ছে না। আমি বায়োমেট্রিকের পক্ষে এবং খুব আশাবাদী মানুষ। তবুও আমি বলছি, এই বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন অন্য কাজ হতে পারে, সন্ত্রাস দমনে কোনো কাজে লাগবে না। কারণ সন্ত্রাসীরা, বিশেষ করে জঙ্গিরা আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে তো বটেই, পুলিশের চেয়েও বেশি স্মার্ট। তারা নিজেদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকা- করবে, আর পুলিশ তাদের খপ করে ধরে ফেলবে; এমনটা যারা ভেবেছেন, তারা বোকার সপ্তমস্বর্গে বাস করছেন। ইতোমধ্যে সিমের ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের খবর পত্রিকায় এসেছে। অনেকে ধরাও পড়েছে। বাজারে নাকি রেজিস্ট্রেশন করা সিমও কিনতে পাওয়া যায়। কে জানে, হয়তো আপনার নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম দিয়েই সন্ত্রাসীরা কাজ চালাচ্ছে। সন্ত্রাসী খুঁজতে খুঁজতে পুলিশ হয়তো আপনার বাড়িতেই হানা দেবে।
তবে আজকের লেখার প্রসঙ্গ ভিন্ন। পত্রিকায় দেখলাম, জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়ায় সময়মতো রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি বলে, সাবেক ১১১টি ছিটমহলের ৪০ হাজার বাসিন্দা ১ জুন থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারছেন না। সংশ্লিষ্ট জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, আগামী নভেম্বরের আগে এই ৪০ হাজার মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে পাবেন না। তার মানে আরও পাঁচ মাস তাদেরকে মোবাইলবিহীন জীবনযাপন করতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশে এটা অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য। ছিটমহল বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় একবছর আগে। আমি ভেবেছিলাম, ছিটমহল বা ছিটের মানুষ শব্দগুলো আর কখনও লিখতে হবে না। কিন্তু একবছর পরও যখন ছিটের মানুষগুলো মোবাইলের মতো জরুরি সেবা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন কষ্ট হয়। এই ৪০ হাজার মানুষ ৬৮ বছর নিজগৃহে পরবাসী ছিল। ছিট বিলুপ্তির সময় আমি লিখেছিলাম, এই মানুষগুলোকে যেন বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়, যাতে তারা দ্রুত বাংলাদেশের অন্য মানুষের কাতারে আসতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব যেন তাদের মন থেকে বঞ্চনার বোধ দূর করা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমরা তা করতে পারিনি। আমি দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তুলে দেওয়া হোক। আর জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও তাদের সিম রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা হোক।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
