নেই তিনি, আছেন তিনি
বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটক হয়েছে, পর্দায় সিনেমা হয়েছে। কিন্তু টেলিভিশনের জন্য কী ফর্মে নাটক হবে, এ কাঠামোটি যে দু’তিনজন গুণী নির্মাতা ঠিক করেছিলেন, তাদের একজন পথিকৃত নাট্যনির্মাতা এই আতিকুল হক চৌধুরী।
২০১৩ সালের ২৬ মার্চ, সন্ধ্যাবেলা কলাবাগানে তার ফ্ল্যাটে তারিক আনাম খান ও নিমা আনামসহ পৌঁছি, তখন ড্রইংরুমের একটা চেয়ারে তিনি বসা। তার স্ত্রী কোনো একটা কাজে ঘরের বাইরে, দুই পুত্র বিদেশে, বাসায় তার এক সহকারী আছে, সে এখানে বসিয়ে রেখে চলে গেছে। এবার তিনি বিছানায় যাবেন। নিজের শক্তিতে উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা এখন তার নেই। এমন কি বিছানায় বসিয়ে দেবার পর নিজের শক্তিতে শুইয়ে পড়ার ক্ষমতাও হারিয়েছেন তিনি।
বিছানায় শুয়ে যখন কথা বলতে শুরু করলেন, তখন তিনি সাবলীল, প্রখর স্মৃতিশক্তি তার। নিমা আনাম ৪ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে একটা বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে ক্যামেরার সামনে এসে কী করেছিলেন স্পষ্ট মনে আছে তার, মনে নেই নিমা আনামেরই।
আতিকুল হক চৌধুরী বলেন, ‘নিজের কথা নিজে বলতে সঙ্কোচবোধ হয়’। কিন্তু আজকে বলছি, ‘গৃহদাহ’ যখন হয় তখন ‘মহিম’ করেছিল আব্দুল্লাহ আল মামুন আর ‘সুরেশ’ করেছিল গোলাম মোস্তফা। সুজাতা করেছিল অচলা। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দুইজন টেলিভিশন ইঞ্জিয়ারকে ডেকে বলেছিলেন, আমাদের তো দুইটা টেলিভিশন যদি কোনো কারণে একটা টেলিভিশন নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন আরেকটা টেলিভিশন সচল থাকে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা খর্ব করে এমন কোনো নাটক ছাড়া সব নাটক টেলিভিশনে চলবে, এর জন্য কারও অনুমতি লাগবে না। উনি নাটকটি দেখেছিলেন। খানিক পরে বললেন, ‘দুইজন শিল্পীর নাম আমি কখনও ভুলব না, একজন হচ্ছে আসাদুজ্জামান নূর আর হুমায়ূন ফরিদী। আমার মনে আছে, নূরকে একবার আমি নাটকে নিয়েছিলাম। নূর ব্যাগ খুলে ব্লেড-কাচি-আঠা বের করে টেবিলের ওপর রাখা শুরু করল, আমি নূরকে বললাম, এগুলো এনেছ কী জন্য? নূর বলল, আপনি কতক্ষণ পরপর সংলাপ দিবেন সেগুলো ব্লেড দিয়ে কেটে আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে দেব, এ জন্য। দোহাই আতিক ভাই এরপর আর কাটাকাটি করেন না।’
একসময় জিজ্ঞেস করি, ‘নাটক তো আপনার প্রাণের সঙ্গেই ছিল। তারপরে আপনি এডমিনিস্ট্রেটিভ কাজও করেছেন। বিটিভিতে ডিডিজি ছিলেন, একুশে টিভিতে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজও করেছেন, ওই জায়গাটা আপনি কিভাবে দেখতেন?’ তিনি বলেন, ওই জায়গাটা আমার জন্য একটা বাঁধা ছিল। প্রশাসনের কাজে আমি কখনোই তৃপ্তি পাইনি। আমি নাটক বানানোর কাজেই আনন্দ পেতাম।
‘জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনি আপনাকে মূল্যায়ন করেন?’
‘আমি মনে করি, আমি একজন সাধারণ নাট্যনির্মাতা ছিলাম।’
‘বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে শুরু করে এই স্যাটেলাইট যুগের স্ক্রিপ্টহীন নাটক পর্যন্ত সবগুলোই আপনার দেখা। প্রায় ৫০ বছর টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের অনেক বিবর্তন আপনি দেখেছেন। এটাকে কেমন করে মূল্যায়ন করবেন?’
‘নাটকের কোনো অবস্থাকে দোষ দেওয়া যায় না। এটা গতিশীল জিনিস। এ অবস্থা চলবে। আবার এই অবস্থায় থাকবে না, নতুন অবস্থায় যাবে। তবে এখন এত হাজার হাজার নাটক হচ্ছে, এর মধ্যে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ এটা দর্শকরাও বুঝতে পারছে না। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্ম, এরা কিন্তু ভালো ভালো নাটক তৈরি করছে। কিন্তু সেই নাটকগুলো চোখে পড়ছে না। আর ভালো নাটক তৈরি না হাওয়ার প্রধান কারণ হলো বাণিজ্যিক। টেলিভিশনের মালিকরা বাণিজ্য ছাড়া কিছু বোঝে না।’
‘পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে কিছু বলুন।’
‘আমি কিন্তু হতাশ না। এই সময় থাকবে না। তরুণ প্রজন্ম আসবে, ভুলত্রুটি বুঝতে পারবে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে নাটক করবে। দেশটাকে জানতে হবে, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, এগুলো জানতে হবে।’ নাট্যকার মামুনুর রশীদের উদ্যোগে ফরিদুর রেজা সাগরসহ খুব অল্পসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মীর কাছ থেকে সামান্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছিলাম আমরা। তার হাতে দিয়ে আসি। প্যাকেটটি তার স্ত্রীর কাছে দিয়ে বললেন, এই মুহূর্তে এটা আমার খুব দরকার ছিল। তোমাদের এই ভালোবাসার ঋণ আমি কোনোভাবেই শোধ করতে পারব না।
আমরা বলি, এ সামান্য মাত্র পিতৃঋণ শোধ।
লেখক : স্থপতি ও নির্মাতা
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন